ফ্রিল্যান্সিং কি? ফ্রিল্যান্সিং থেকে কত টাকা আয় করা যায়?

করোনাকালীন সময় মানুষ গৃহবন্দী অবস্থায় ফ্রিল্যান্সিং পেশায় আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে, কারণ এটি এমন একটি প্রফেশন যা ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব। বর্তমান সময়ে ‘ফ্রিল্যান্সিং’ শব্দটি হরহামেশাই শোনা যায়। ফেসবুক থেকে শুরু করে টিভি চ্যানের, সংবাদপত্র সবকিছুতেই প্রায় সময় এই শব্দের দেখা মেলে। অনেকে ফ্রিল্যান্সিং শব্দটি সম্পর্কে সঠিক ভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি বা অনেকে আছেন ফ্রিল্যান্সিং শব্দটা খুব রিসেন্টলি শুনেছেন।

আজকে আমরা ‘ফ্রিল্যান্সিং’ কি তা নিয়ে সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবো যাতে আপনাদের বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মে।  ফ্রিল্যান্সিং শব্দটি যেহেতু ইংরেজি শব্দ, সেহেতু এর অনেক গুলো ফর্ম থাকতে পারেন। তাই মাঝে মাঝে বাক্যের ধরণ অনুযায়ী এইগুলো চেইঞ্জ হয়ে ফ্রিল্যান্স, ফ্রিল্যান্সিং, ফ্রিল্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে। আশাকরি পাঠক বিষয়টি সহজভাবে দেখবেন।  

ফ্রিল্যান্সিং কি? 

ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে একটি ‘মুক্তপেশা’। মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী- যে ব্যাক্তি কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত বা প্রভাবিত না হয়ে মুক্ত বা স্বাধীন ভাবে কাজ করে তিনি হচ্ছেন ফ্রিল্যান্সার। আর পুরো প্রফেশনকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সিং। 

কেম্ব্রিজ ডিকশনারির “মতে- ভিন্ন ভিন্ন অর্গানাইজেশনের জন্য নির্দিষ্ট/বিশেষ কিছু কাজ করে দেওয়া হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং অর্থাৎ সাধারণ চাকুরির ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন কর্মীকে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করতে হয়। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং এ একজন ফ্রিল্যান্সার অর্গানাইজেশন/প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে কাজ করতে পারে, যাকে সবাই মুক্ত পেশা বলছে।  ফ্রিল্যান্সিং কি আসলে মুক্ত পেশা কিনা সেটির বিতর্ক না হয় আরেকদিনের জন্য জমা থাকলো। আজকের পোস্ট নিজের গতিতে চলুক। 

সর্বপ্রথম ফ্রিল্যান্সিং আইডিয়া 

ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে এমআইটির দুজন স্বপ্নবাজ তরুনের হাত ধরে। তখন এর নাম ছিলো Elance। আইডিয়াটা অসাধারণ ছিলো। কারণ যে কেউ ঘরে বসে বা তার সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কোন কাজ শেষ করতে পারতো। যেখানে ধরাবাধা কোন অফিস টাইম নেই। ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স  ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলোপ থেকে শুরু করে কন্টেন্ট রাইটিং সহ যা যা কাজ ভার্চুয়ালি করা সম্ভব তা সবই করা হয়। এইক্ষেত্রে দুই পক্ষ থাকেন কাজ দেওয়া এবং নেওয়ার ক্ষেত্রে। একপক্ষকে বলা হয় ক্লায়েন্ট/বায়ার অন্যপক্ষকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার/সেলার।

ক্লায়েন্ট / বায়ার কারা? 

ক্লায়েন্ট হচ্ছে যারা কাজ দিয়ে থাকেন বা যাদের কাজ করিয়ে নেওয়ার দরকার তাদেরকে ক্লায়েন্ট বা বায়ার বলে সম্বোধন করা হয়। অনেকটা অর্গানাইজেশন বা প্রতিষ্ঠানের মত। এর অর্থ হচ্ছে যে পক্ষ কাজ দিয়ে থাকেন তাদের পক্ষের লোকজনকে ক্লায়েন্ট বা বায়ার বলা হয়ে থাকে। 

ফ্রিল্যান্সার / সেলার কারা? 

যারা কাজ করে, মূলত চাকুরীজীবী হচ্ছে ফ্রিল্যান্সার/সেলার। ক্লায়েন্টরা এই সকল ফ্রিল্যান্সার থেকে কাজ গুলো করিয়ে নেন। বায়ারদের কোন কিছুর প্রয়োজন হলে তারা মার্কেটপ্লেসে এসে ফ্রিল্যান্সারদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারেন। ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজাদার এবং স্বচ্ছন্দের বিষয় হচ্ছে ক্লায়েন্ট কিম্বা ফ্রিল্যান্সার সবাই নিজেদের পছন্দমত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং অর্গানাইজেশন নির্বাচন করতে পারে। যেটি বোধ হয় এই প্রফেশনকে মুক্ত পেশা বলার অন্যতম কারন। 

ফ্রিল্যান্সিং  মার্কেটপ্লেস কি? 

ফ্রিল্যান্সিং  মার্কেটপ্লেস কি?

ধরুন একজন ফ্রিল্যান্সার সফটওয়্যার বানানোয় বেশ দক্ষ এবং একজন ক্লায়েন্টের সফটওয়্যার বানানোর কাজ পারে এমন ফ্রিল্যান্সার এর প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে এরা একে অপরকে কিভাবে খুঁজে পাবে? হ্যাঁ, ক্লায়েন্ট এবং ফ্রিল্যান্সার যেখানে একে অপরকে খুঁজে পায় সেই স্থানকে বলা হয়ে থাকে মার্কেটপ্লেস। মার্কেটপ্লেস গুলো এমন ভাবে ডিজাইন করা থাকে, যেন খুব সহজে একজন ফ্রিল্যান্সার এবং একজন ক্লায়েন্ট কাজ খুঁজে পান বা কাজ করিয়ে নিতে পারেন। বর্তমান সময়ে বেশ কিছু ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস রয়েছে। যেমন- ফাইভার, আপওয়ার্ক, পিপলপারয়াওয়ার, ৯৯ডিজাইন্স, টাপোল, উই ওয়ার্ক রিমোটলি এবং ড্রিবল সহ অনেক অনেক জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস রয়েছে। আপনি আপনার কাজের ধরণ অনুযায়ী এই সকল ফ্রিল্যান্সিং সাইট গুলো নির্বাচন করতে পারবেন। 

বিড কি? 

একজন ফ্রিল্যান্সারকে কাজের আবদানের জন্য পুরো প্রক্রিয়াকে বিড বলা যায়, অনেকটা প্রপোজাল এর মত। এখানে ফ্রিল্যান্সার তার কাজের বিবরন, কাজের ধরণ, দাম এবং সময় সহ আরো অনেক কিছু সংযুক্ত করার মাধ্যমে যে প্রপোজাল তৈরি করে থাকেন তাকে বিড বলা যায়। ক্লায়েন্ট বিডের মাধ্যমে সকল আবেদনকৃত ফ্রিল্যান্সারদের বিশেষত্ব দেখতে পায়। এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট তার প্রয়োজন মত সবচেয়ে যোগ্য ব্যাক্তিত্বকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। 

কারা হতে পারে ফ্রিল্যান্সার?

এই মুক্ত পেশার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে  এখানে যে কেউ এই পেশায় সংযুক্ত হতে পারে। এখানে ধরাবাধা কোন প্রকার একাডেমিক যোগ্যতা লাগে না। সবাই ফ্রিল্যান্সার হতে পারে, শুধু প্রয়োজন হয় কাজের দক্ষতার। যদি কেউ কোন কাজে দক্ষ হয়, তাহলে সে ফ্রিল্যান্সার হতে পারে। স্কিল হচ্ছে  সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। এখানে ক্লাস সিক্সের বাচ্ছা থেকে শুরু করে বা তারও আগের গ্রেডের কেউ হ’লেও যদি যে কোন কাজে যোগ্য হয়, তাহলে সে ফ্রিল্যান্সার হতে পারবে। তবে হ্যাঁ, একটা যোগ্যতা সবার থাকা চাই। সেটি হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা। কারণ এখানে যেহেতু দেশের কোন গন্ডি নেই, সারা বিশ্ব যেখানে এক, যেখানে নেই কোন কাটা তারের বেড়া যেখানে একটা ভাষা সবাইকে ব্যবহার করতে হয় যোগাযোগের জন্য। আর তা হ’লো ইংরেজি, যার জন্য এটিকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা হয়। এই ইংরেজি ভাষা না জানা থাকলে বা কমিউনিকেশন ইংরেজিতে না করতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে টিকে থাকা খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। 

শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে মার্কেটপ্লেসে অনেক কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এখানে যে যত সম্ভব নেটিভদের মতো করে কথা বলতে এবং লিখতে পারবে, তার জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ অনেক বেশি সুগম থাকে। এরপর প্রয়োজন হয়, একটি মোটামুটি মানের কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ। অনেকে তর্ক করে, মোবাইলেও ফ্রিল্যান্সিং করা যায়। হ্যাঁ, করা যায়। তবে সবচেয়ে সুবিধাজনক একটি ল্যাপটপ অথবা একটি কম্পিউটার থাকা। 

উন্নতমানের ব্রডব্যান্ড কানেকশন সংযুক্ত করতে পারলে সেটি আরো বেশি কাজে দিবে। যদিও বাংলাদেশে এখনও ইন্টারনেট সংযোগ গুলো অতটা ভালো নয়। তারপরও একেবারে না থাকার চেয়ে এটিও ঢের ভালো। জানা যায় এখন মফস্বলেও ব্রডব্রান্ড কানেকশন পাওয়া যায়। আপনি আপনার এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ব্রডব্রান্ড কানেকশন থাকলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা। নতুবা আপনাকে ডাটার পেছনে প্রচুর টাকা ঢালতে হতে পারে। ইংরেজি জানা, একটি কম্পিউটার/ল্যাপটপ থাকা, ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগ এবং কোন একটি বিশেষ কাজে যদি দক্ষ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনিও হতে পারেন একজন ফ্রিল্যান্সার।  

ফ্রিল্যান্সিং থেকে কত টাকা আয় করা যায়?

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব মুশকিল। কারণ এখানে পেশাটি যেমন মুক্ত, তেমন সবকিছুই মুক্ত। আপনার আয়ের সীমাও মুক্ত। আয় করার বিষয়টি সম্পূর্ন নির্ভর করে আপনার কাজের ধরন এবং পরিমানের উপর। আমার লেখাটা যেহেতু বাংলায় লেখছি, তখন বাংলাদেশি কিছু পরিচিত ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের বিবরনের কথা বললেই ভালো হয়। আমার দেখা মতে, গড়ে দেশের সফল ফ্রিল্যান্সারদের আয় ১০০০-২০০০ ডলার পর্যন্ত। এটি কোন ভুয়া তথ্য নয়, অনেকে অনেক রকম আয় করে থাকেন, যেটা পুরোটা নির্ভর করে কাজের যোগ্যতা এবং কাজের ধরণের উপর। এখানে যেহেতু আয়ের কোন সীমা নেই, তাই সর্বোচ্চ আয়ের হিসেব করাও সঠিক ভাবে সম্ভব নয়।ফ্রিল্যান্সিং এর টাকায় অনেকে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন, এইরকম উদাহারণও অনেক।  

তবে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, ফ্রিল্যান্সিং মানে টাকা আর টাকা বিষয়টা এমন নয়। দেশের অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কল্যানে বেশির ভাগ আগ্রহী ফ্রিল্যান্সার ভালো কাজ শিখতে পারেন না। ফলে তারা ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে এবং ফ্রিল্যান্সিং এর আয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহে থাকেন। অনেক নেতিবাচক ধারণা জন্মে। একটা বাক্য চরম সত্য, আপনি যদি কাজ পারেন, তাহলে আপনার কাজের অভাব হবে না। তবে দক্ষ হতে হবে। যেই কাজই পারেন, সেটিতে সকলকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।

অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং শেখার উপায়

Leave a Reply