স্যামসাং কিভাবে তৈরি হলো?

অর্থনৈতিক প্রবিদ্ধির জন্য বাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল উভয় ক্ষেত্রে ব্যবসা মুনাফা অর্জনের একটি সহজ এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য ব্যবসায়িক কোম্পানির থেকে ইলেকট্রনিক এবং টেকনোলজি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং স্যামসাং সহ এরকম অন্যান্য কোম্পানি দ্রুত বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক আমরা অনেকেই নিয়মিত স্যামসাং ফোন ইউজ করি কিন্তু স্যামসাং সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা। আমরা স্যামসাং কে যা ভাবি এটি তার থেকেও অনেক বড় এবং প্রসিদ্ধ কোম্পানি। আমাদের আজকের পোস্টে আমরা স্যামসাং কিভাবে তৈরি হলো? স্যামসাং কত বড়? এবং স্যামসাং এর ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। কথা না বাড়িয়ে চলুন শুরু করা যাক।

স্যামসাং এর ইতিহাস

স্যামসাং প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করা লি বিয়ং চল। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার ইউরিংয় এলাকার একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার কর্মজীবন শুরু করার লক্ষে ১৯৩৮ সালে তিনি ডেইগ নামক একটি শহরে আসেন। সেখানে তিনি ৪০ জন কর্মী নিয়ে একটি নুডুলস তৈরির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। 

তারা নুডুলস তৈরির পাশাপাশি পুরো শহরজুড়ে বিভিন্ন গ্রোসারী পণ্য সরবরাহের কাজ করতো। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পুরো পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছিলো। এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে এবং ব্যবসা প্রসারিত করতে লি বিয়ং চল তার নুডুলস তৈরির কোম্পানির মূল অফিস দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে স্থানান্তর করেন। 

এরপর ১৯৫০ সালের দিকে তিনি তার ব্যবসা প্রসারিত করতে স্যামসাং চেম্বার অফ কমার্স নামক একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হয় এবং লি বিয়ং চলকে বাধ্য হয়ে তার প্রতিষ্ঠিত স্যামসাং গ্রুপকে সিউল থেকে বুসান শহরে সরিয়ে নিতে হয়। তবে তিনি হাল না ছেড়ে তার কোম্পানি টিকিয়ে রাখেন।

উইকিপিডিয়া কিভাবে কাজ করে?

কোরিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লি বিয়ং চল বুসানে একটি চিনি পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠানটি স্যামসাং গ্রুপের একটি অংশ হিসেবে কাজ শুরু করে। তারপর লি ডিয়েগো তে স্যামসাং এর অন্তর্ভুক্ত একটি উল তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এভাবে ধীরে ধীরে লি বিয়ং চল স্যামসাং গ্রুপকে প্রসারিত করতে থাকেন।

এভাবে স্যামসাং একেরপর এক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে করতে নিজেদের ব্যবসা প্রসারিত করে আসছে। এপর্যন্ত স্যামসাং সরাসরি ছোট এবং বড় মিলিয়ে মোট ৮০ টি ব্যবসার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত আছে। মোটকথা স্যামসাং শুরু হয়েছিল একটি ছোট নুডুলস তৈরির কারখানা থেকে যা আজকের বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

স্যামসাং কিভাবে তৈরি হলো?

স্যামসাং কিভাবে তৈরি হলো?

স্যামসাং শুরুর দিকে কখনো চিন্তাও করেনি যে তারা ইলেকট্রনিকস দুনিয়ায় প্রবেশ করবে। কিন্তু স্যামসাং এর প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং চল ছিলেন অনেক দূরদর্শী মানুষ। তিনি শুরু করেছিলেন ট্রেডিং ব্যবসা থেকে এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য সেকশনে প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত করেন।

১৯৬০ সালের দিকে স্যামসাং ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির বাজারে প্রবেশ করে। সে সময় তারা একটি ১২ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি তৈরি করে বাজারজাত করে। যা বিশ্বকে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। এরপর ১৯৭০ সালের মধ্যভাগে তারা কনস্ট্রাকশন এবং শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে। এগুলো ছাড়াও স্যামসাং এর রিটেইল, টেক্সটাইল, ইনস্যুরেন্স, ফুড প্রসেসিং, সিকিউরিটি সহ অনেক বিজনেস আছে।

যাহোক, স্যামসাং আসলে অনেক লম্বা সময় ধরে তৈরি হয়েছে। ১৯৩৮ সালে তারা একটি ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। যেখানে তারা নুডুলস তৈরির পাশাপাশি পুরো শহর জুড়ে গ্রোসারী পণ্য সরবরাহ করতো। অর্থনৈতিক মন্দা চলার কারণে তাদের এই বিজনেস অনেক ভালোভাবে চলতে থাকে। 

কিন্তু তারপর স্যামসাং এর প্রতিষ্ঠাতা পার্টনারশিপে বেশ কয়েক জায়গায় ইনভেস্ট করে। এতে ব্যবসা পরিচালনায় মতভেত থাকায় পার্টনারের থেকে আলাদা হয়ে স্যামসাং তার ব্যবসা বড় করার চেষ্টা করে। তারপর কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় এবং স্যামসাং এর মূল ব্যবসা সিউল থেকে বুসানে স্থানান্তরিত করতে হয়। এসকল উত্থান পতন পার করে তারা তাদের আপন গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে।

পর্যায়ক্রমে স্যামসাং ইলেকট্রনিক, টেলিকমিউনিকেশন, কনস্ট্রাকশন সহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা শুরু করে। যার ফলে স্যামসাং দক্ষিণ কোরিয়ার সবথেকে বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়।

স্যামসাং কত বড়?

স্যামসাং হলো সাউথ কোরিয়ার সবথেকে বড় কোম্পানি। যা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জিডিপির ১৭ শতাংশ। স্যামসাং মোট ৮০ টি ব্যবসার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। তারা পুরো বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্য এবং সার্ভিস সরবরাহ করে থাকে।

স্যামসাং বিশ্বের সবথেকে বেশি মেমোরি চিপ তৈরি করা কোম্পানি। তাদের তৈরি করা চিপ অ্যাপল তাদের আইফোন ৪, আইফোন ৪ এস, আইফোন ৫, আইফোন ৫ এস ডিভাইসে ইউজ করে আসছে। স্যামসাং অ্যাপলের সবথেকে বড় পণ্য সরবরাহকারী।

বিশ্বের সবথেকে বড় বড় জাহাজ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্যামসাং অন্যতম। তাদের স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ নামক শিপবিল্ডিং কোম্পানি অনেক বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরি করে থাকে। তাদের তৈরি জাহাজ আয়তনে অনেকটা একটি ছোট শহরের মত। তাদের শিপবিল্ডিং কোম্পানির আয়তন ৫২০৪ টি ফুটবল খেলার মাঠ এক জায়গায় করলে যতটুকু হবে ঠিক ততটুকু।  

তারা কনস্ট্রাকশন বিজনেসেও অনেক এগিয়ে গিয়েছে। দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফা, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার এবং তাইওয়ানের তাইপে ১০১ নামক সুউচ্চ দালান তৈরি করেছে স্যামসাং। তারা তাদের কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্ট স্যামসাং সিএন্ডটি কর্পোরেশন নামক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশের শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বর্ধিত টার্মিনালের কাজ করার জন্য স্যামসাং চুক্তিবধ্য হয়েছে।

স্যামসাং টেকউইন নামক একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যারা সিকিউরিটি এবং অয়াপন নিয়ে কাজ করে। তারা দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য জেট বিমান, ক্যানন, মেশিনগান ইত্যাদি অস্ত্র তৈরি ও সরবরাহ করে থাকে। তাদের তৈরি SGR-A1 একটি রোবটিক মেশিন গান যা সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূর থেকে নির্ভুলভাবে লক্ষ নির্ধারণ করে আঘাত করতে পারে। এই মেশিনগানটি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বর্ডার এলাকা সুরক্ষিত রাখতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে তাদের Everland নামে একটি থিম পার্ক আছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ভিজিট করে। এছাড়া স্যামসাং ডিজিটাল সিটি নামে তাদের একটি নিজস্ব মিনি সিটি আছে যেখানে তাদের ম্যাক্সিমাম বিজনেস পরিচালিত হয়।

কম্পিউটার স্লো হওয়ার কারন কি?

সংখ্যায় হিসেব করতে গেলে স্যামসাং এ মোট ৪ লাখ ৮৯ হাজার কর্মী কাজ করে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তাদের সার্ভিস পাওয়া যায় তবে কয়েকটি বড় বড় শহরে তারা তাদের রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের মোট কর্মী সংখ্যা এত বিশাল যে গুগল, অ্যাপল এবং মাইক্রোসফটের মোট কর্মীসংখ্যা এক করলেও তাদের সমান হবে না।

২০১৪ সালের তথ্যমতে তাদের মোট আয় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে স্যামসাং এর বার্ষিক আয় ছিল ৩০৫ বিলিয়ন ডলার যা তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল এবং গুগলের থেকে অনেক বেশি। এ থেকে বোঝা যায় স্যামসাং অনেক অনেক বড় একটি কোম্পানি।

স্যামসাং এর কিছু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টস

স্যামসাং এর কিছু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টস
  • স্যামসাং একটি নুডুলস তৈরির কোম্পানি ছিল।
  • স্যামসাং প্রথম রঙিন টিভি তৈরি করে এবং রিমোট দিয়ে টিভি চালানোর যুগের সূচনা করে।
  • তারা প্রথম স্মার্টওয়াচ প্রযুক্তি আবিষ্কার করে।
  • স্যামসাং প্রথম ডিজিটাল মোবাইল (যেখানে অডিও গান বাজানো যায়) বাজারে আনে। 
  • তারা প্রথম এমোলেড ডিসপ্লে তৈরি করে।
  • স্মার্ট টিভি এবং বড় ডিসপ্লে সম্বলিত টিভি স্যামসাং প্রথম তৈরি করে।
  • তারা প্রথম ১০৮ মেগা পিক্সেল ক্যামেরা সম্বলিত ফোন তৈরি করেছে
  • তারাই প্রথম বিশ্বকে ওয়্যারলেস চার্জার এবং ফোলডেবল স্মার্টফোন প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

স্যামসাং আমাদের প্রত্তাহিক জীবনে ব্যবহার করা হয় এমন সকল পণ্য তৈরির পাশাপাশি অনেক বড় বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য অন্যান্য ব্যবসার জন্য অনেক সহায়ক। আশাকরি এই পোস্ট পড়ে স্যামসাং সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে। স্যামসাং সম্পর্কে আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাবেন ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *