বিশ্বসেরা ৫ টি হ্যাকিং গ্রুপ

প্রযুক্তি বিশ্বে হ্যাকিং একটি প্রতিষ্ঠিত অস্ত্র যা দিয়ে সহজে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে কুপোকাত করা যায়। ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ান হ্যাকার গ্রুপ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে। সে টাকা এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। 

হ্যাকিং এর কারনে অনেক কোম্পানি বড় ধরনের অর্থ লসের শিকার হয়। অনেক দেশের সরকার নিজস্ব পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপ পরিচালনা করে। যাদের কাজ থাকে শত্রু রাষ্ট্রকে টেকনোলজি ইউজ করে বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন করা। অন্য দেশের সাইবার হামলা থেকে নিজের দেশকে সুরক্ষা দেওয়া ছাড়াও পাল্টা আক্রমণ করা। প্রতিটি হ্যাকিং গ্রুপের একটি বিশেষ মটো বা উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা ৫ টি বিশ্বসেরা হ্যাকিং গ্রুপ সম্পর্কে জানবো। তো চলুন শুরু করা যাক।

অ্যানোনিমাস

অ্যানোনিমাস একটি ইন্টারন্যাশনাল হ্যাকিং গ্রুপ, তারা নিজেদের পরিচয় দেয় অ্যানোন হিসেবে। ২০০৩ সালে একই মতাদর্শের কিছু ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট অ্যানোনিমাস গ্রুপ প্রতিষ্ঠিা করে। তারা সাধারন সম্মলিত ডিডস অ্যাটাক করে সার্ভার অকেজো করে দেয়। তারা বিভিন্ন সোশ্যাল ইস্যুতে নিজেদের কার্যক্রম দ্বারা সরাসরি প্রতিবাদ করে।

অ্যানোনিমাস  শুরুর দিকে বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে হ্যাকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে নিন্দার শিকার হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, উগান্ডা সহ অনেক দেশের সরকারি ওয়েবসাইটে হামলা করে। এছারাও তারা পেপাল, মাষ্টার কার্ড, ভিসা এবং সনির উপর সাইবার হামলা চালায়।

উইকিলিকস সমর্থন করার কারনে অনেকেই তাদের সমালোচনা করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা অন্যায়ের পথ থেকে ন্যায়ের পথে আসে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই অ্যানোনিমাসের সদস্য আছে। তাদের ডিজিটাল রবিনহুড, ডিজিটাল মাফিয়া ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।

তারা চেহারা লুকানোর জন্য গাই ফক্সের মাস্ক ব্যাবহার করে। গাই ফক্স স্প্যানিশদের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা একজন বিপ্লবী। তারা মাস্ক ইউজ করা বাদেও মাথা বিহীন একটি মানুষের শরীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে।  

সিরিয়ান ইলেক্ট্রনিক আর্মি

সিরিয়ান ইলেক্ট্রনিক আর্মি

২০১১ সালে সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাসার-আল-আসাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিরিয়ান ইলেক্ট্রনিক আর্মি প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা সরকারি সাপোর্টে বিভিন্ন শত্রু দেশর সাইবার স্পেসে প্রতিনিয়ত হামলা চালায়। স্পামিং থেকে শুরু করে ডিডস, ম্যালওয়্যার, ফিশিং ইত্যাদি হ্যাকিং মেথড ইউজ করে।

হ্যাকিং কি? হ্যাকিং কত প্রকার?

অন্য দেশের উপর হামলা করা বাদেও তারা নিজেদের উপর হামলা রোধ করে। এ পর্যন্ত তাদের টার্গেট লিস্টে বিবিসি নিউজ, আল-জাজিরা, ফিনান্সিয়াল টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, সিবিসি নিউজ গুলো। এছাড়া যারা সিরিয়ার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করে তাদের টার্গেট করে।

২০১২ সালে তারা লিংকডইন হ্যাক করে বাসার-আল-আসাদের একটি সাপোর্ট ওয়েবসাইটে রিডাইরেক্ট করে। তারা দ্য অনিয়ন এর টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে গুগল অ্যাপসের ফিশিং ইউজ করে। এছাড়া ট্রুকলার, ভাইবারের মতো VoIP সার্ভিস হ্যাক করে। তারা অনলাইন ম্যাগাজিন এবং নিউজ ওয়েবসাইট সহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বেশি টার্গেট করে।

লিজার্ড স্কোয়াড

লিজার্ড স্কোয়াড একটি ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার গ্রুপ। ৭ জন সক্রিয় মেম্বার নিয়ে তারা ২০১৪ সালে কার্যক্রম শুরু করে। তারা প্রধানত বিভিন্ন গেম কোম্পানি টার্গেট করে। বিশেষ করে এক্সবক্স এবং প্লেস্টেশনের অনলাইন সার্ভার ডিডস অ্যাটাকের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়াই তাদের কাজ।

লিগ অফ লিজেন্টস নামক গেম সার্ভার ডিডস অ্যাটাকের মাধ্যমে বন্ধ করে দিয়ে তাদের হ্যাকিং জার্নি শুরু করে। তারা প্লেস্টেশন, এক্সবক্স গেম সার্ভার সহ নর্থ কোরিয়ার ইন্টারনেট সার্ভিস ১ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়। এর আগে ডিসেম্বর ২ তারিখে Machinima.com নামের একটি ওয়েবসাইট হ্যাক করে ফ্রন্ট পেজে লিজার্ড স্কোয়াড এর ASCII আর্ট ঝুলিয়ে দেয়।

২৫শে ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে তারা ঘোষণা করে এক্সবক্স এবং প্লেস্টেশনের অনলাইন সার্ভার ডিডস অ্যাটাক শুরু করে। এই অ্যাটাক ২৬শে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এই দিনেই তারা টর নেটওয়ার্কের উপর হামলা চালায়। তবে টর নেটওয়ার্কে হামলা চালানো নিয়ে তাদের সম্পৃক্ততার সাথে মতভেদ আছে।

বিটকয়েন কি? বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে?

২০১৪ সালে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট MH370 নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি লিজার্ড স্কোয়াড উক্ত এয়ারলাইন্সের ওয়েবসাইট হ্যাক করে। হ্যাক করার পর সেখানে একটি পেজ রিডাইরেক্ট করে দেয় যেখানে “404 – Plane Not Found” লেখা ছিল।

এরকম সফল অ্যাটাক পরিচালনার পরেও তারা তিনটি মিথ্যা অ্যাটাকের কথা প্রচার করে যা ছিল পুরোটাই বানোয়াট। তারা ঘোষণা করে সনির সিইও বহনকারী আমেরিকান এয়ারলাইনের একটি বিমানে বোমা আছে। ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করার পর কোন বোমা পাওয়া যায়নি।

এরপর তারা টেইলর সুইফটের টুইটার এবং ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার কথা বলে এবং বিটকয়েন দাবী করে। তারা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং টিন্ডার হ্যাক করার কথা টুইটারে ঘোষণা করে। পরে তাদের এই দুটো হ্যাকের ঘটনাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

মাস্টার্স অফ ডিসেপশন

মাস্টার্স অফ ডিসেপশন

১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত Legion of Doom নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ সক্রিয় ছিল। পরে সেই গ্রুপের আদলে Acid Phreak নামক একজন ১৯৮০ সালের পর মাস্টার্স অফ ডিসেপশন নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে।

তারা গতানুগতিক হ্যাকিং থেকে একটু অন্য ধারার কাজ করে। তারা বিভিন্ন কম্পিউটার সিস্টেম এবং ফোন কোম্পানি টার্গেট করে এক্সপ্লইট তৈরি করে। এসব এক্সপ্লইট ইউজ করে নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেস নিয়ে মেইন সার্ভারে প্রবেশ করে ইউজার নেম এবং পাসওয়ার্ড খুঁজে বের করে।

অন্য সব হ্যাকিং গ্রুপ কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হলেও মাস্টার্স অফ ডিসেপশন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের কোন মোটিভ বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। মাস্টার্স অফ ডিসেপশন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে নিউ ইয়র্ক থেকে।

ব্যুরো ১২১

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ব্যুরো ১২১ উত্তর কোরিয়ান হ্যাকার এজেন্সি। ব্যুরো ১২১ উত্তর কোরিয়ার মিলিটারির একটি অংশ। তারা জলে, স্থলে এবং আকাশে যেমন সৈন্য নিয়োগ করেছে তেমনি ব্যুরো ১২১ তাদের অনলাইন মিলিটারি।

বিভিন্ন সুত্রমতে ব্যুরো ১২১ এজেন্সিতে মোট ১৮০০ জন সদস্য আছে। যারা প্রত্যেকেই নর্থ কোরিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ অটোমেশন থেকে গ্রাজুয়েশন করা এবং অনলাইন হ্যাকিং নিয়ে ৫ বছর ট্রেনিং নেওয়া। ব্যুরো ১২১ তাদের এজেন্টদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয় যাতে সহজে তাদের ট্র্যাক করা না যায়। তারা প্রত্যেকেই অনেক ভালো মানের হ্যাকার এবং প্রোগ্রামার।

গোপনীয়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারা খুব সচেতন। ব্যুরো ১২১ তে কাজ করা একজন কর্মী আরেকজন কর্মী সম্পর্কে জানে না। তাদের প্রতিজনের পরিবার ব্যুরো ১২১ এ চাকরি করার কারনে আলাদা সুবিধা এবং ভাতা পায়।

তাদের প্রাইমারী টার্গেট হলো দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে তারা সনি পিকচারস এর একটি মুভি সম্প্রচার হ্যাক করে বন্ধ করে দেয়। তার সাথে সাথে তারা দক্ষিন কোরিয়ার ৩০ হাজার কম্পিউটার হ্যাক করে অকেজো করে দেয়। এতে পুরো দক্ষিন কোরিয়ার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মিডিয়া ব্রডকাস্টিং এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্টের ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে ছিল।

কুখ্যাত হ্যাকার গ্যারি ম্যাকিনন এর জীবনী

একটি গেমিং অ্যাপ্লিকেশনে ম্যালওয়্যার ইনফেক্ট করে ২০১৩ সালে দক্ষিন কোরিয়ার হাজার হাজার স্মার্টফোন হ্যাক করে। অনেকেই ধারণা করে ব্যুরো ১২১ এর কাছে এমন কিছু টেকনোলজি আছে যা অন্য কারো কাছে নেই। এই শক্তি ইউজ করে তারা অনেক বড় ধরনের সাইবার যুদ্ধ যে কোন সময় শুরু করে দিতে পারে। আমেরিকা কর্তিপক্ষ ২০০৯ সালের পর থেকে হওয়া সকল বড় সাইবার হামলার জন্য ব্যুরো ১২১ দায়ী করে। 

আমরা দশের লাঠি একের বোঝা প্রবাদ সম্পর্কে জানি। ঠিক তেমনি একজন হ্যাকার থেকে একটি হ্যাকার গ্রুপ অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা নিমিষেই অনেক বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে যা একজন হ্যাকারের করতে বছরের পর বছর লাগে। আশাকরি পুরো লেখা পরে আপনি ৫ টি সেরা এবং ডেঞ্জারাস হ্যাকিং গ্রুপ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। আপনার কোন মতামত জানাতে চাইলে কমেন্ট বক্সে জানাবেন ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *