ভয়ংকর হ্যাকার
হ্যাকিং একটি আর্ট, নিয়মিত প্র্যাকটিস করার মাধ্যমে এই আর্ট রপ্ত করা যায়। এই জ্ঞান মানুষ ভালো এবং খারাপ উভয় কাজেই ব্যবহার করতে পারে। কারো ক্ষতি করা হোক বা উপকার করা হোক এ দুটোই নির্ভর করে আপনার মন মানসিকতা কেমন তার উপর। বিশ্বে এমন অনেক অনেক দেশ আছে যারা সরকারি টাকা দিয়ে হ্যাকার পোষেন। বিভিন্ন সময়ের সাইবার আক্রমন যাতে দেশের অনলাইন সিস্টেম অচল করে দিতে না পারে সে লক্ষে এসব হ্যাকার কাজ করে। এসব প্রাতিষ্ঠানিক হ্যাকার বা বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপ বাদেও কিছু বিশ্ববিখ্যাত হ্যাকার আছেন। যারা কম্পিউটার আর ইন্টারনেট দিয়ে বিশ্ব জয় করেছেন। আমাদের আজকের পোস্টে হ্যাকার আদ্রিয়ান লামোর জীবন কাহিনী সম্পর্কে জানবো। যাকে বাস্তব জীবনে হোমলেস হ্যাকার বলা হয়।
আদ্রিয়ান লামো কে?
আদ্রিয়ান লামো একজন আমেরিকান হ্যাকার এবং থ্রেড এনালিস্ট। তিনি একজন গ্রে হ্যাট হ্যাকার। অর্থাৎ তিনি একাধারে হোয়াইট হ্যাট এবং ব্লাক হ্যাট হ্যাকার ছিলেন। হ্যাকিং জীবনে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক এবং সিস্টেম হ্যাক করে সিকিউরিটি এক্সপার্ট হিসেবে চাকরি করবেন। কিন্তু তার পূর্ববর্তী অপরাধ কর্মের কারনে কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান তাকে চাকরি দেয়নি। এ কারনে তাকে সারাজীবন ভবঘুরে হয়ে কাঁটাতে হয়েছে।
ভাগ্য কখনোই তার সাথে ছিল না। তার জীবনের কয়েকটি বড় অর্জনের মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস হ্যাক করা ছিল অন্যতম। এছাড়াও তিনি ছোট বড় অনেক সিস্টেম হ্যাক করে তার পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এদের মধ্যে ইয়াহু এবং মাইক্রোসফট সহ আরও অনেক টেক কোম্পানি এবং নিউজ মিডিয়া কোম্পানি বিদ্যমান।
দ্য ম্যানিং অ্যাফেয়ার্স নামক একটি প্রতিবেদন উইকিলিকস এ প্রকাশ করে তিনি রিপোর্টার হিসেবে পারদর্শিতা দেখায়, এটি ছিল তার জীবনের একটি বড় সিদ্ধান্ত। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত টিভি প্রোগ্রামে অপরাধ এবং এর নিরাময় নিয়ে নিজস্ব মতবাদ আলোচনা করতেন।
কুখ্যাত হ্যাকার গ্যারি ম্যাকিনন এর জীবনী
তিনি মাত্র ৩৭ বছর বেঁচে ছিলেন, যে সময়টুকু বেঁচে ছিলেন সে সময় অনেক গোপন কর্মকাণ্ড ফাঁস করে দিয়ে গেছেন। একই সাথে তিনি যে একজন ভালো মানের রিপোর্টার তার প্রমান পাওয়া গেছে। এই সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অন্যতম সফল গ্রে হ্যাট হ্যাকার।
ব্যক্তিগত জীবন
লামো ১৯৮১ সালে আমেরিকার বোস্টনে জন্মগ্রহন করেন। তিনি একাধারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, হ্যাকার, জার্নালিস্ট এবং কম্পিউটার সাইন্টিস্ট ছিলেন। তার বাবার নাম ছিল মারিও লামো জিমেনিজ ও মাতার নাম ছিল মেরি লামো এটউড।
লামো ছোট বেলা থেকেই অনেক ভাবুক মানুষ ছিলেন। তার পিতামাতার ভাষ্য মতে তার সামনে কম্পিউটার রিলেটেড কোন সমস্যা দিলে তিনি সাথে সাথে সমাধান করে দিতেন। ছোট বেলা থেকেই তার মধ্যে একটি দক্ষ এনালিস্ট এর পরিচয় পাওয়া যায়।
হাই স্কুলে তিনি একবার তার গ্রেড থেকে উপরের গ্রেড এর একটি কম্পিউটার ক্লাস এ সমস্যা সমাধান করা নিয়ে শিক্ষকের সাথে ঝামেলায় পড়ে যায়। এরপর তাকে যদিও সাময়িক বহিষ্কার করা হয় কিন্তু এর পরেও তিনি ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর লামো তার পুরো মনোযোগ দেন সমকামী এবং হিজড়া দের জন্য তৈরি ফোরামে। সেখানে তার কাজ ছিল যারা ফোরাম এ আসবে তাদের ফোরামের বিভিন্ন পেজে আটকে রাখা। কারন পেজ ভিজিট এর কারনে AOL তাদের পেইড অ্যাডভারটাইজিং থেকে পেমেন্ট প্রদান করতো। লামো ভিজিটরদের সাথে লম্বা সময় ধরে চ্যাটিং করতো এবং তাদের উক্ত ফোরামে ধরে রাখতো।
২০১০ সালের দিকে লামো চেলসি ম্যানিং বা ব্রাডলি ম্যানিং নামক একজন আমেরিকান হিজড়া সেনা সদস্যের মেসেজ পান। সে তাকে বলে বাগদাদে করা একটি এয়ার স্ট্রাইক যেখানে ২ জন রয়টার্স রিপোর্টার সহ মোট ১২ জনকে হত্যা করা হয় সেই ভিডিও তিনি লিক করবেন। এতে তিনি লামোর সহযোগিতা চায়। লরেন ফিসার নামক একজন টিভি অ্যাক্টর ছিল তার জীবন সঙ্গী। তাদের পরিচয় হয় লামোর সরাসরি মিডিয়া ওয়ার্ল্ড এ চলাচল থাকার কারনে।
হ্যাকিং জীবন
লামো তার হ্যাকিং জীবন শুরু করে বিশ্ব বিখ্যাত বিভিন্ন মিডিয়া কোম্পানির সিস্টেম হ্যাক করে। তাকে হোমলেস হ্যাকার বলা হয়। সে কখনোই একটি নির্দিষ্ট যায়গা বা নেটওয়ার্ক দিয়ে হ্যাক করতেন না। তার হ্যাক করার স্থান ছিল কফি শপ, লাইব্রেরী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিন। যেহেতু তাকে কোন এক যায়গায় পাওয়া যেত না সেহেতু হ্যাক করার পর তিনি তার ট্র্যাক মুছতেন না। তিনি জানতেন এই ট্র্যাক ধরে কেউ তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।
হ্যাকিং শেখার উপায় – হ্যাকিং শিখবো কিভাবে
তিনি প্রথম মিডিয়ার চোখে পড়েন নিউ ইয়র্ক টাইমস হ্যাক করে। সেখানে তিনি তাদের ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক হ্যাক করে ডাটাবেসে প্রবেশ করেন। সেখানে বিখ্যাত ব্যক্তিদের একটি তালিকা এডিট করে নিজের নাম এবং কন্টাক্ট অ্যাড করে দেন। সেখানে তিনি লেক্সিসনেক্সিস নামের একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তাদের হাই রিসার্চড ডাটা অ্যাক্সেস করতেন।
লামো AOL Time Warner, Comcast, MCI Worldcom, Microsoft, SBC Communications এবং Yahoo হ্যাক করে ওয়েব প্রক্সি ব্যাবহার করে। কারন সে সময় তাদের ইন্টারনাল সিস্টেমে রিমোট অ্যাক্সেস করার দুর্বলতা ছিল। লামো বিভিন্ন ওয়েব প্রক্সি ইউজ করে উক্ত সিস্টেমে রিমোট অ্যাক্সেস নিতে পারতো।
বিচার ও শাস্তি
২০০২ সালে লামোর করা হ্যাকের কারনে নিউ ইয়র্ক টাইমস কেস ফাইল করে। সেখানে ১৫ মাস তদন্ত করে লামোকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর তাকে ২০০৪ সালে শাস্তির আওতায় আনা হয়। লামোকে ২ বছরের প্রবেশন সহ ৬ মাস গৃহ বন্দী থাকার আদেশ দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি তাকে ৬৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। এই শাস্তি দেওয়ার কারন ছিল তিনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ইয়াহু! ও ওয়ার্ল্ডকমের নিরাপত্তা দুর্বলতা প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য।
শেষ জীবন এবং মৃত্যু
লামো অনেক ট্যালেন্টেড একজন হ্যাকার। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তাকে দুনিয়া ত্যাগ করতে হয়। তিনি নিজে দাবী করেন তিনি একজন Asperger’s সিনড্রোম এর শিকার। হ্যাকার ওয়ান্টেড নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করা হয়েছিল তাকে নিয়ে কিন্তু তা আর রিলিজ করা হয়নি।
লামো তার পুরো জীবন একজন ঘর ছাড়া ভভঘুরে জীবন কাটান। তার প্রাক্তন প্রেমিকা তাকে নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন “লামো ছিল খুব রাগী একজন মানুষ। সে উত্তেজিত হলে তাকে অনেক শাসন করতো এবং তার শর্টগান দিয়ে ভয় দেখাতো”। পরে অবশ্য লামো এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এছারাও তিনি বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতেন। ২০১৫ সালে তিনি কোরা তে ডার্ক ওয়েব নামক সিরিজে কোলাবরেট করেন। তার লেখা আস্ক আদ্রিয়ান বইটি ৩ কোটি বারের বেশি দেখা হয়। এই বইয়ে তিনি কোরা তে করা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব লিখেন।
শেষে ২০১৮ সালে আদ্রিয়ান লামো ক্যানসারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৩৭ বছর। তার এই রহস্যময় মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী ছিল কি না তা দেখার জন্য ফরেনসিক টেস্ট করা হলেও কোন কারন দেখানো সম্ভব হয়নি।
হ্যাকিং একটি রোমান্সকর কাজ হলেও এর ঝুঁকি ভুলে গেলে চলবে না। একজন হ্যাকার সমাজে তখনি স্বীকৃতি পাবে যখন তার কাজ মানবতার কল্যাণে লাগবে। আমরা চেষ্টা করবো আমাদের জ্ঞান আমরা ভালো কাজে ব্যয় করবো। আজকের লেখায় আমরা হোমলেস হ্যাকার আদ্রিয়ান লামো সম্পর্কে জানলাম। আশাকরি এই লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। আপনার মতামত জানানোর জন্য নিচে কমেন্ট করবেন ধন্যবাদ।