লিনাক্স কি?

আমরা বর্তমানে যে কম্পিউটারের সাথে পরিচিত তা শুরুর দিকে এমন ছিল না। কম্পিউটার আবিষ্কারের পর গণনা শাস্ত্রে একটি বিশাল বিপ্লব ঘটে। তখনকার দিনে কম্পিউটার ব্যবহার করা হতো একটু অন্য ভাবে। কারণ সেই সময় ছিল না কোন মাউস বা কীবোর্ড বা গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস। 

কম্পিউটার ব্যবহারের কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতিও ছিল না। কাজের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম তৈরি করে কাজ করা হতো। এই পুরো প্রক্রিয়া ছিল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এক জায়গায় করে অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়। বর্তমানে আমরা যে সকল অপারেটিং সিস্টেমের কথা জানি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ম্যাক ওএস, উইন্ডোজ এবং লিনাক্স। আজকে আমরা লিনাক্স সম্পর্কে জানবো।

লিনাক্স কি?

লিনাক্স একটি কার্নেল যা অপারেটিং সিস্টেম তৈরিতে কাজে লাগে।  লিনাস টরভল্ডস ১৯৯১ সালে প্রথম লিনাক্স কার্নেলের আবিষ্কার করেন। এটি একটি ওপেন সোর্স কার্নেল যার সোর্স কোড উন্মুক্ত। আপনি নিজে চাইলে এই কার্নেল ফ্রীতে ডাউনলোড দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো ওএস তৈরি করে নিতে পারবেন।

লিনাক্স কে গ্নু জেনারেল পাব্লিক লাইসেন্স ভি ২ এর আন্ডারে ওপেন সোর্স হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর পর থেকে ডেভেলপাররা এই কার্নেল ব্যবহার করে গ্নু এর প্যাকেজ সহকারে অনেকগুলো কমপ্লিট ওএস তৈরি করে। লিনাক্সের ভাষায় আমরা যেগুলোকে ডিস্ট্রো বলি। উল্লেখযোগ্য কিছু ডিস্ট্রো হলো Ubuntu, CentOS, Linux Mint, Fedora, Kali Linux ইত্যাদি।

ইউটিউব থেকে কিভাবে আয় করা যায়?

পার্সোনাল কম্পিউটারের জন্য ডেভেলপ করা এই লিনাক্স ডিস্ট্রো গুলো লাইটওয়েট এবং ইউজার ফ্রেন্ডলি। এর সিকিউরিটি অনেক শক্তিশালী হওয়ার কারণে সুপার কম্পিউটার গুলো লিনাক্স ব্যবহার করে। লিনাক্স(এর ডিস্ট্রো গুলো) একটি আদর্শ অপারেটিং সিস্টেম যা সুপার কম্পিউটার, মেইনফ্রেম কম্পিউটার, সার্ভারে ব্যবহার করা হয়।

লিনাক্স এর ডিস্ট্রো গুলো সাধারণত তৈরি করা হয় বিভিন্ন চাহিদার উপর ভিত্তি করে। যেমন ব্যাসিক ইউজার দের জন্য লিনাক্স মিন্ট, হ্যাকিং এর জন্য কালী লিনাক্স এবং সার্ভার ম্যানেজ করার জন্য সেন্টওএস ব্যবহার করা হয়। লিনাক্স নিয়ে কাজ করতে গেলে সাধারণ ইউজার যে সমস্যায় পরে তা হলো কমান্ড দিয়ে কাজ করা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য লিনাক্সে ডেক্সটপ এনভাইরমেন্ট ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ KDE, GNOME, Xfce, MATE, Cinnamon ইত্যাদি।

বর্তমান সময়ের সবথেকে বেশি জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম এন্ড্রয়েড তৈরি করা হয়েছে লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে। সারাবিশ্বে মোট অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীর ২% লিনাক্স ব্যবহার করে। যদিও অন্যান্য ওএস এর তুলনায় এটি অনেক নগণ্য কিন্তু এই ইউজার বেস দিন দিন বাড়ছে।   

লিনাক্স কিভাবে তৈরি হলো?

লিনাক্স কিভাবে তৈরি হলো?

লিনাক্স তৈরির ইতিহাস জানার আগে আমাদের আরও একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। ১৯৮৩ সালে রিচারড স্টলম্যান একটি ওপেন সোর্স প্রকল্প ঘোষণা করেন এবং এর নাম দেওয়া হয় গ্নু (GNU) বা মুক্ত সফটওয়্যার। এই প্রকল্পের প্রধান কাজ ছিল ওপেন সোর্স সফটওয়্যার দিয়ে একটি পুরনাঙ্গ ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা। 

এই অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করার জন্য যে সকল কম্পোনেন্ট দরকার ছিল তার সবকিছুই ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় কার্নেল নিয়ে। কারণ মাইক্রোকার্নেল খুব জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করতো যার ফলে তাদের কাজ অনেক সময় সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এই সমস্যা থেকে তারা যখন ওঠার চেষ্টা করছে সে সময় একজন ফিনিস ছাত্র  লিনাস টরভল্ডস শেখার জন্য কার্নেল নিয়ে কাজ শুরু করে। সে সময় মিনিক্স নামে একটি ইউনিক্স অপারেটর নিয়ে তিনি কাজ শুরু করে। 

মাইক্রোসফট কিভাবে তৈরি হলো?

কিন্তু ওই অপারেটিং সিস্টেম সরাসরি বা এর রচয়িতা আন্ড্রু টানেনবমের অনুমতি ছাড়া কাস্টমাইজ করে যেত না। তাই  লিনাস টরভল্ডস আলাদা একটি সিস্টেম তৈরির পরিকল্পনা করেন এবং এভাবেই তিনি লিনাক্স কার্নেল তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে তিনি এই কার্নেল মার্কেটে উন্মুক্ত করে দেন এবং এটি সাথে সাথে বিশ্বে সারা ফেলে দেয়। সেদিনের সেই অর্জনের কারণে আজকে আমরা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারছি। 

লিনাক্স এর সুবিধা অসুবিধা কি?

প্রতিটি অপারেটিং সিস্টেমের সুবিধা এবং অসুবিধা আছে। লিনাক্স নিজের এর ব্যতিক্রম নয়। তো চলুন লিনাক্স এর সুবিধা অসুবিধা গুলো জেনে নেই।

সুবিধা

লিনাক্স একটি ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। যেখানে একটি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম কিনতে অনেক টাকা খরচ করতে হয় সেখানে লিনাক্স সম্পূর্ণ ফ্রী। আপনি উইন্ডোজ এর একটি ভার্শন কিনলে সেটি মাত্র একটি কম্পিউটারে ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু লিনাক্স আপনি একাধিক কম্পিউটারে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারবেন এবং এর জন্য আপনাকে কোন টাকা খরচ করতে হবে না।

যেখানে উইন্ডোজ আপডেট আপনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে রাখে সেখানে লিনাক্স অন্য কাজের পাশাপাশি সিস্টেম আপডেটের সুবিধা দেয়। উইন্ডোজ আপনাকে আপডেট ডাউনলোড দেওয়ার জন্য বাধ্য করবে কিন্তু লিনাক্সে আপনি আপনার ইচ্ছা মতো ডাউনলোড করতে পারবেন। আপডেট ডাউনলোড করার পর সেগুলো ইন্সটল করার জন্য উইন্ডোজ রিস্টার্ট দিতে হয় কিন্তু লিনাক্স চালু থাকা অবস্থায় ইন্সটল করার অনুমতি দেয়।

উইন্ডোজ ব্যবহারকারীর জীবনে ভাইরাস একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। ম্যালওয়্যার, ট্রোজান, স্পাইওয়্যার, র‍্যানসমওয়্যার ইত্যাদি উইন্ডোজ সিস্টেমের সব থেকে বড় শত্রু। উইন্ডোজের ইউজার অনেক বেশি থাকার কারণে হ্যাকার রা এই সিস্টেম কে টার্গেট করে ভাইরাস বানায়। অপরদিকে লিনাক্স ১০০% সুরক্ষিত সিস্টেম না হলেও এর সিকিউরিটি সব থেকে বেশি। অনেকে বলে লিনাক্স পুরোটাই ভাইরাস ফ্রী ওএস। আসলে লিনাক্স ওপেন সোর্স হওয়ার কারণে কেউ ভাইরাস তৈরি করলেও সাথে সাথে কেউ এর প্রতিষেধক বের করে ফেলে। তাই এটি উইন্ডোজ সহ সকল অপারেটিং সিস্টেমের থেকে সুরক্ষিত।

 লিনাক্স সরাসরি কম্পিউটারে ইন্সটল না দিয়েও লাইভ আকারে চালানো যায়। কিন্তু অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেম এই সুবিধা দেয় না। আপনি সিম্পল একটা পেনড্রাইভ দিয়ে লিনাক্স ইন্সটল এবং টেস্ট করে দেখতে পারবেন। কিন্তু অন্য ওএস আপনাকে আগে ইন্সটল দিতে হবে এবং পরে টেস্ট করে দেখতে পারবেন।

 লিনাক্সে অ্যাপ বা সফটওয়্যার ইন্সটল দেওয়া খুব সহজ এবং বেশীরভাগ লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে অ্যাপ গুলো প্রি-ইন্সটল হিসেবে থাকে। কিন্তু উইন্ডোজ বা ম্যাক এ আপনাকে ম্যানুয়ালি ইন্সটল করতে হয়। লিনাক্সে টার্মিনাল ব্যবহার করে সহজেই কাজ করা যায়।

লিনাক্স আপনাকে আপনার অপারেটিং সিস্টেমের পুরো কন্ট্রোল দিয়ে দেয়। আপনি চাইলেই যে কোনো ধরণের পরিবর্তন বা নতুন কিছু যোগ করতে পারবেন। কিন্তু উইন্ডোজ এবং ম্যাক আপনাকে সিস্টেম ফাইল অ্যাক্সেস বা ডিলিট বা এডিট করতে দেবে না।

 লিনাক্স এ ওয়াইন নামক একটি অ্যাপ দিয়ে উইন্ডোজ এর মোটামুটি অনেক সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়। এছারাও লিনাক্স অনেক লাইটওয়েট অপারেটিং সিস্টেম যা অনেক পুরাতন মডেলের কম্পিউটারে চলে। অন্যদিকে উইন্ডোজ বা ম্যাক অনেক ভারী এবং লেটেস্ট সিস্টেম সাপোর্ট করে।

 অসুবিধা

লিনাক্সের সুবিধা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এর কতগুলো সুবিধার মধ্যে কিছু অসুবিধা আছে। চলুন সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেই। 

লিনাক্সের সব থেকে বড় সমস্যা এর ড্রাইভার পাওয়া যায়না। যেহেতু লিনাক্স ওপেন সোর্স তাই ড্রাইভার নির্মাতা কোম্পানি এদের জন্য কোন ড্রাইভার বানায়না কারণ কেউ ফ্রী তে কিছু দিতে চায়না, যার ফলে লিনাক্স ব্যবহার করলে ড্রাইভার নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। যদিও দিন দিন এই সমস্যা কমে আসছে কিন্তু এর সহজ কোন সমাধান এখনো বের হয়নি।

লিনাক্স দিয়ে গেম খেলতে গেলে আপনাকে ঝামেলায় পরতে হবে। যদিও লিনাক্সের গেম টার্গেট করে বানানো ডিস্ট্রো আছে তবুও এটি উইন্ডোজের মতো কখনোই না। এক কথায় গেম খেলতে চাইলে আপনাকে উইন্ডোজ ব্যবহার করতেই হবে।

লিনাক্স অনেকটাই টেক পার্সনদের জন্য, কারণ সাধারণ ইউজার এর গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস থেকে লিনাক্স এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে না। টার্মিনাল ব্যবহার করে অ্যাপ বা প্যাকেজ ইন্সটল করা অনেকের কাছেই ঝামেলার।

লিনাক্স এর ভবিষ্যৎ কি?

লিনাক্স এর ভবিষ্যৎ কি?

লিনাক্স ভবিষ্যতে অনেক ভালো পর্যায় যাবে এর পিছনে কারণ হিসেবে বলতে গেলে এর ওপেন সোর্স হওয়ার গুণকেই ধরা যায়। ভবিষ্যৎ কম্পিউটার দুনিয়া অনেক পরিবর্তন হবে। ১৯২৫ সালের মধ্যেই মানুষ তার নিজের তথ্যকে গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। যেহেতু লিনাক্স অনেক সিকিউরড অপারেটিং সিস্টেম সেহেতু এটি ভবিষ্যতে মানুষের মনে সবথেকে বেশি জায়গা করে নিবে।

 ইতিমধ্যে বড় বড় কোম্পানি তাদের নিজস্ব সিস্টেমে লিনাক্স ব্যবহার করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোম্পানি গুলো হলো ওরাকল, আইবিএম, গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, ডেল, স্যামসাং এবং মাইক্রোসফট নিজেই লিনাক্স ব্যবহার করে। তাহলেই চিন্তা করেই দেখুন ভবিষ্যতে লিনাক্স কোন পর্যায় যাবে।

পুরো আর্টিকেল পড়ে আমরা লিনাক্স সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। লিনাক্স কি, লিনাক্স কীভাবে তৈরি হলো, লিনাক্স এর সুবিধা এবং অসুবিধা নিয়ে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। যদিও বর্তমানে মোট অপারেটিং সিস্টেম ইউজারের ২% লিনাক্স ব্যবহার করে কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে মাইক্রোসফট তাদের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে লিনাক্স ব্যবহার করার কথা ঘোষণা করেছে। এর থেকেই প্রমান পাওয়া যায় যে লিনাক্স ভবিষ্যৎ মার্কেটে রাজত্ব করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *