তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের বর্তমান এ যুগে আমাদের চারপাশ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ঠাসা। এখন আমরা কমবেশি সবাই কম্পিউটার, ট্যাবলেট, ক্যামেরা, ল্যাপটপ ইত্যাদি নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে থাকি। এসব ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল অনেক কার্যক্রম প্রতিনিয়তই সম্পন্ন করছি। এগুলোর মধ্যে যেমন অফিসের কার্যক্রম রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে চ্যাটিং, ভিডিও কল সহ আরো অন্যান্য অনেক বিষয় পরিচালনা করা হচ্ছে।
এসব ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলোর মধ্যে বিশেষ করে স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ইত্যাদি বর্তমানে আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা এবং ডিভাইসগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ রক্ষার্থে এসব ডিভাইসের একটি অভিন্ন পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। যাতে ভবিষ্যতে ডিভাইসগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং যে কোন অপরাধকে চিহ্নিতকরণ করা যায়। এজন্য সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসেরই ইউনিক ঠিকানা রয়েছে যা আইপি অ্যাড্রেস নামে পরিচিত।
আধুনিক ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলো আমাদের যেরকম সুবিধা করে দিয়েছে তেমনি ভাবে এগুলোর অপব্যবহার করে আমাদের বিভিন্ন ক্ষতিও করা হচ্ছে। তাই এরকম কোন পরিস্থিতির শিকার হলে তা খুঁজে বের করার জন্য আইপি অ্যাড্রেস হলো প্রধান হাতিয়ার। ধরুন আপনার মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে আপনি কাউকে হুমকি-ধামকি দিলেন। এখন ওই ব্যক্তি চাইলে কতৃপক্ষের নিকট আপনার মোবাইল নাম্বার বা অ্যাড্রেস দিয়ে অভিযোগ করতে পারবে। যেহেতু আইপি অ্যাড্রেস একটি ইউনিট নাম্বার তাই খুব সহজেই আপনার ডিভাইসটির পরিচয় খুঁজে বের করা যাবে। এছাড়া আরো নানা কারণে আইপি অ্যাড্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইপি এড্রেস কি?
আইপি অ্যাড্রেস (IP Address) এর পূর্ণরূপ হল ইন্টারনেট প্রটোকল ঠিকানা (Internet Protocol Address) এটি এমন একটি ঠিকানা যা নেটওয়ার্কে থাকা কোন ডিভাইসকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করে। আপনি নিশ্চয়ই এর আগে আইপি অ্যাড্রেস দেখে থাকবেন। আইপি অ্যাড্রেস সাধারণত এমন হয়ে থাকে ১৯২.১৬৮.১.৩৪।
একটি আইপি অ্যাড্রেস সবসময় উপরে দেখানো চারটি পৃথক সংখ্যার কম্বিনেশনের মত হয়ে থাকে। আইপি অ্যাড্রেস এ থাকা প্রত্যেকটি নাম্বারের রেন্জ ০ থেকে ২৫৫ পর্যন্ত হতে পারে। তাই বলতে পারেন, সর্বনিম্ন আইপি এড্রেসটির কম্বিনেশন ০.০.০.০ থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ২৫৫.২৫৫.২৫৫.২৫৫ পর্যন্ত হতে পারে।
মূলত বিভিন্ন ধরনের জটিল সংখ্যার ধারণা প্রসেসিংয়ের জন্য এমনটি হয়ে থাকে। এখানে সর্বোচ্চ ২৫৫ সংখ্যাটি একটি অক্টাল (০-৭) নাম্বার। কিন্তু আমরা জানি কম্পিউটার শুধুমাত্র বাইনারি সংখ্যা বুঝতে পারে এবং কম্পিউটারের সব ধরনের কার্যক্রম বাইনারি নাম্বারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই বাইনারি নাম্বারের সাথে কম্বিনেশন ঠিক রাখার জন্যই এমনটি করা হয়ে থাকে। যেমন আমরা যদি ১৯২.১৬৮.১.৩৪ সংখ্যাটিকে বাইনারিতে প্রকাশ করি তাহলে তা দাঁড়ায় এরকম ১১০০০০০০.১০১০১০০০.০০০০০০০১.০০১০০০১০।
কম্পিউটার শুধু বাইনারি সংখ্যা ০ ও ১ বুঝলেও মানুষের পক্ষে এ ভাষায় কম্পিউটারকে নির্দেশনা দেয়া অনেক কঠিন। এজন্য আমরা সাধারণত ডেসিমেল নাম্বার নিয়ে কাজ করে থাকি। কিন্তু আমরা যে আইপি এড্রেসটি দেখে থাকি তা মূলত বাইনারি সংখ্যারই ফসল। কারণ ডিভাইসের মধ্যে তা বায়নারি ভাষায় কনভার্ট করা থাকে।
আইপি এড্রেস কত প্রকার?
আইপি এড্রেসকে আমরা দুইটি অংশ ভাগ করতে পারি। যথাঃ (১) নেটওয়ার্ক আইডি এবং (২) হোস্ট আইডি
নেটওয়ার্ক আইডিঃ আমরা আগেই বলেছি যে আইপি অ্যাড্রেস মূলত চারটি ভিন্ন সংখ্যার কম্বিনেশন। যেগুলোকে ডট চিহ্ন দ্বারা আলাদা করা থাকে। এই চারটি সংখ্যার কম্বিনেশনের মধ্যে প্রথম তিনটি কম্বিনেশনকে বলা হয়ে থাকে নেটওয়ার্ক আইডি। যেমন- একটি ডিভাইসের আইপি এড্রেস যদি হয়ে থাকে ১৯২.১৬৮.১.৩৪ তাহলে তার প্রথম তিনটি অংশ অর্থাৎ ১৯২.১৬৮.১ হলো এর নেটওয়ার্ক আইডি। কিন্তু সব সময় এ তিনটি অংশের সাথে একটি ০ যোগ করে চারটি অংশ করে একে নেটওয়ার্ক আইডি হিসেবে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ এখানকার পূর্ণ নেটওয়ার্ক আইডিটি হলো ১৯২.১৬৮.১.০।
হোস্ট আইডিঃ কোন আইপি অ্যাড্রেস এর চারটি অংশের মধ্যে সর্বশেষ অংশটি হলো হোস্ট আইডি। অর্থাৎ নেটওয়ার্ক আইডি নেয়ার পর যে অতিরিক্ত অংশটি থাকে তাই হোস্ট আইডি। যেমন- ১৯২.১৬৮.১.৩৪ আইপি অ্যাড্রেস এর ক্ষেত্রে হোস্ট আইডি হলো ৩৪। হোস্টা আইডিটিই মূলত ব্যবহারকারী ইউনিক পরিচয় বহন করে।
নেটওয়ার্ক আইডি ও হোস্ট আইডি বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনি কোন শহরে বাস করেন যেখানকার একটি ঠিকানা হলো “৩৪ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ”। এই ঠিকানায় কিন্তু অনেক বাড়ি থাকতে পারে। আর এ ঠিকানাটিকেি আপনি নেটওয়ার্ক আইডির সাথে তুলনা করতে পারেন। কিন্তু এখন যদি ঠিকানাটা আমি এমন ভাবে বলি যে বাড়ি নং ১১, ৩৪ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। এ ঠিকানায় থাকা বাড়ির নাম্বারটি হলো হোস্ট আইডির মত। যা ব্যবহারকারীর একবারে সঠিক পরিচয় বহন করে। এজন্য একই নেটওয়ার্ক আইডি অনেকগুলো থাকতে পারে কিন্তু হোস্ট আইডি সবসময় একক অর্থাৎ ইউনিক হয়।
আইপি এড্রেস কিভাবে কাজ করে?
ইন্টারনেটে যখন একটি ডিভাইস অন্যটির সাথে কানেক্টেড হয় তখন তাদের মধ্যে সঠিক ভাবে যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু নাম ঠিকানা না জানলে কিভাবে কোন ডিভাইস অন্য আরেকটি ডিভাইসের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে? আমরা মানুষেরা অনেক সময়ে বিভিন্ন ডিভাইস এর নানা ধরনের নাম দিয়ে থাকি যেমন- জয়ের আইফোন বা রনির ল্যাপটপ ইত্যাদি এবং ইন্টারনেটে যেকোনো ওয়েবসাইট অ্যাক্সেস করার সময় আমরা তার নির্দিষ্ট একটি ডোমেইন নেইম ব্যবহার করি। এ সকল প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য ডিভাইস গুলোর মধ্যে একটি ইউনিক পরিচয় থাকা প্রয়োজন। আর এই কাজটি করা হয়ে থাকে আইপি অ্যাড্রেস ব্যাবহারের মাধ্যমে।
ইন্টারনেটে যুক্ত থাকা প্রত্যেকটি ডিভাইসেরই হার্ডওয়ারে ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রটোকল বা ইন্টারনেট প্রটোকল নামক ব্যবস্থা যুক্ত আছে যা নির্ধারণ করে থাকে সিস্টেমের কোন ডিভাইসটির সাথে কোনটি যুক্ত থাকবে এবং একে অপরের সাথে ডাটা শেয়ার করবে। এটা তাদের নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ এবং আইপি অ্যাড্রেস এর মত ইউনিক সংখ্যাগুলো হলো তাদের একে অপরকে বোঝার এবং যোগাযোগ করার উপায়।
যখন কোন ব্যক্তি তার ডিভাইস টি ব্যবহার করে ওয়েবসাইটকে অ্যাক্সেস করার চেষ্টা করে তখন এই নাম্বারগুলোর মাধ্যমেই বুঝতে পারা যায় আসলে ব্যবহারকারী কার সাথে কমিউনিকেশন করতে চাচ্ছে। এই কাজটি করার জন্য ডিভাইসটি সর্বপ্রথম নেটওয়ার্ক রাউটারের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করেন। এরপর সরাসরি সার্ভারটির মাধ্যমে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে এবং যে ফাইল গুলো খোঁজা হচ্ছে সেগুলো ব্যবহারকারীকে দেখানো হয়।
এই সিস্টেমের মধ্যে থাকা প্রত্যেকটি ডিভাইস যেমন কম্পিউটার, রাউটার, সার্ভার প্রত্যেকটিরই একটি নির্দিষ্ট এবং ইউনিক আইপি অ্যাড্রেস রয়েছে যার মাধ্যমে এগুলোকে আইডেন্টিফাই করা যায়। আর এভাবেই আইপি এড্রেসের মাধ্যমে ডিভাইস গুলো জানতে পারে কোন ওয়েবসাইটে যেতে হবে এবং কোন কম্পিউটারের বা ফোনের সাথে কোন ইনফরমেশনগুলো শেয়ার বা ডেলিভারি করতে হবে।
আসলেই কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা বা পরিচয় ছাড়া কোথাও সঠিকভাবে পৌঁছানো যায় না। তা বাস্তব জীবনে হোক বা মেশিনের ভিতরের কার্যক্রমে। আর তাই প্রত্যেক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ইউনিক পরিচয় হিসেবে আইপি অ্যাড্রেস ডিভাইসগুলোর মধ্যকার সকল কার্যক্রম কোন প্রকার বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে ভূমিকা রাখে। আবার কোন ডিভাইস হারিয়ে গেলে বা অপরাধ ঘটলে আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করেই খুঁজে পড়া পাওয়া যায় এদের পরিচয় ও অবস্থান।