বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এখন কোথায়? বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর ইতিহাস

বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এখন কোথায়

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে আমরা প্রত্যেকে যত আলোচনা করে থাকি না কেন সাধারণ মানুষের মাঝে এই স্যাটেলাইট নিয়ে কৌতুহুলের শেষ সীমা নেই। বিশেষ করে এই স্যাটেলাইটের বর্তমানে অবস্থান এখন কোথায় সেটা নিয়ে মানুষের কৌতুহুল অনেক বেশি। তাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বর্তমান অবস্থান নিম্নে আলোচনা করা হলো

স্যাটেলাইট মানেই যে কোন রকেট বা তাতে এক গাদা যন্ত্রপাতি বসানো থাকবে তা কিন্তু নয়। বরং স্যাটেলাইট এর সাধারণ অর্থ হলো এর চেয়ে সাধারণ। একটি ছোট অবজেক্ট যদি কোন বড় অবজেক্টকে কেন্দ্রকে লাগাতার কোন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে তাহলে তাকে স্যাটেলাইট বলে। যেমন চাঁদ হলো পৃথিবীর একমাত্র প্রকৃত উপগ্রহ। কারণ পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ একে পৃথিবী চার পাশে প্রদক্ষিণ করতে বাধ্য করেছে। মহাকাশে রকেটে করে ছেড়ে দেয়া স্যাটেলাইট, যেগুলোকে আমরা কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট হিসেবে চিনি। এগুলো আসলে আর্টিফিশিয়াল অর্থাৎ মানুষের তৈরি কৃতিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। আর এগুলো একটি নির্দিষ্ট করা পথে অবিরত প্রদক্ষিণ করে এবং এটি বৃত্তকার বা উপবৃত্তকার কক্ষপথে ও পৃথিবী থেকে বিভিন্ন দূরত্বে প্রদক্ষিণ করতে পারে। এটি সাধারণত প্রথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরে অবস্থিত থাকে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৭০০ কিলোমিটার উচ্চতায় যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ ১ অংশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ৩৬০০০ কিলোমিটার উপর থেকে এটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে একে চুড়ান্তভাবে বসানো হয়েছে এবং রাশিয়ান স্যাটেলাইট কোম্পানী ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ এই অরবিটাল স্লট ক্রয় করেছে। প্রায় ৩.৭ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে আমাদের এই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি। এই স্যাটেলাইটটি ওজন প্রায় ৩৬০০ কেজি এবং এতে রয়েছে স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার। এর মধ্যে ২০ টি বাংলাদেশ নিজে ব্যবহার করবে আর বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হবে। এর জন্য গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড নামের বিশেষ রাষ্ট্রীয় কোম্পানী।

অপটিক্যাল ফাইবার কি? অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ অন্তত ৪০ প্রকার সেবা দিবে। যেমন- স্যাটেলাইট টেলিভিশন সম্প্রচার, ভি-স্যাট বেতার ইত্যাদি। ভি-স্যাট হচ্ছে ছোট আকৃতির সংযোগযন্ত্র যা দ্বিমুখী ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। এটির থালা আকৃতির অ্যান্টেনার ব্যাস ৩ মিটারেরও কম, যেখানে অন্যান্য উপগ্রহ কেন্দ্রের ব্যাস হয় ১০ মিটারের মতো। ভি-স্যাট সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় বিক্রয় কেন্দ্রে ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত আদান-প্রদানের জন্য। শুধুুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রতেই ১,০০,০০০ এর অধিক গ্যাস স্টেশন ভি-স্যাট ব্যবহার করে থাকে এবং এগুলো এছাড়াও রয়েছে ডিটিএইচ (ডাইরক্টে টু হোম) সেবা, ইন্টারনেট সেবা প্রভৃতি।বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দ্বারা বাংলাদেশের বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে, কারণ নিজেদের স্যাটেলাইট হলে বাংলাদেশকে আর বিদেশী স্যাটেলাইট চড়া বা বেশি মূল্যে ভাড়া নেয়ার প্রয়োজন হবে না।

আশা করা যাচ্ছে এই স্যাটেলাইটটি কমপক্ষে ১৫ বছর কর্মক্ষম থাকবে। মহাকাশে নিজেদের স্যাটেলাইট থাকা মানে অনেক দিক থেকে সেফ থাকা। তবে বিশেষ করে ইন্সপেকশন সম্ভব এক স্থানে বসে থেকে। স্যাটেলাইটটি ছেড়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা বা জানা। মহাকাশে বিভিন্ন স্যাটেলাইট ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে প্রত্যেকটা স্যাটেলাইটের কাজ আলাদা আলাদা।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর ইতিহাস

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তৈরি করেছেন বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা স্যাটেলাইট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের অ্যালেনিয়া স্পেস। এটি বাংলাদেশে প্রথম সম্প্রচার উপগ্রহ ও ভূস্থির যোগাযোগের স্যাটেলাইট। ২০১৮ সালের ১১ মে কেনেডি স্পেস সেন্টার হতে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। বাংলাদেশ এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৫৭ তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ মে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দিবাগত রাত ২ টা ১৪ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পটি টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও ডাক বিভাগ এর অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছে। ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের পেলোড করে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ফ্যালকন ৯ এমন একটি রকেট যেটা বার বার ব্যবহার যোগ্য এবং এই রকেটে করেই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেইলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়।

বাংলাদেশে ২০০৮ সালে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা BTRC কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরির বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। তারপর ২০০৯ সালে ন্যাশনাল তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃতিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যথাযথভাবে যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ তার নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক Telecommunication ইউনিটের (আইটিইউ) কাছে বাংলাদেশ আবেদন করে। ২০১২ সালের মার্চে এই কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থার ডিজাইন তৈরি করার জন্য প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান “স্পেস পার্টনারশীপ ইন্টারন্যাশনাল” কে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাহিরের অংশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রং এর নকশার ওপর স্পস্টভাবে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু।

স্যাটেলাইট ক্রয় করতে ফ্রান্সের থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানীর সাথে প্রায় ২ হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বাংলাদেশের বিটিআরসি। এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ২০ কিস্তিতে ১২ বছরে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই বিটিআরসি ২০১৫ সালে রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানী ইন্টারস্পুটনিকের কাছে (অরবিটাল স্লট) ক্রয় করার আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। যার মূল্য ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কৃত্রিম উপগ্রহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানী লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় ২০১৭ সালে এবং সংস্থাটির প্রাথমিক মূলধন হিসেবে ৫০০০ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে এখনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেব দায়িত্ব পালন করে আসছেন মো: সাইফুল ইসলাম। তিনি ডাক, তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগের অতিরিক্ত সচিব। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী এবং তিনি প্রথিষ্ঠানটির মহা-ব্যবস্থাপক। তাছাড়া ড. শাহ্জাহান মাহমুদ চেয়াম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও পরিচালনায় রয়েছেন। বাংলাদেশের এটি নিজস্ব ও সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ। কৃত্রিম উপগ্রহটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে গাজিপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়াতে অবস্থিত উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রে থেকে।

কৃত্রিম উপগ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নামে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতা সম্পন্ন মোট ৪০ টি কে-ইউ এবং এর কার্যক্ষমতা ধরা হয়েছে ১৫ বছর।

স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে

স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে

স্যাটেলাইট মূলত একটি বস্তু (অবজেক্ট) যেখানে শুধুমাত্র বলকে কাজে লাগানো হয়ে থাকে। স্যাটেলাইট মহাকাশে ভেসে থাকে ও অতি দ্রুত অতিক্রম করে এবং এটি পৃথিবীতে ছিটকেও পরে না। স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে নির্দিষ্ট গতিতে সবসময় ঘুরতে থাকে। এটি পৃথিবীর ও মহাকাশের মহাকর্ষন শক্তির ফলে ছিটকে যায় না এবং নির্দিষ্ট অক্ষে অবস্থান করে।

মহাকাশে (সরকারী-বেসরকারী) প্রায় কয়েক হাজার মানুষের তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহ সমস্ত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। তবে প্রত্যেকটা স্যাটেলাইট ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিয়োজিত এবং এগুলো মধ্যে কোন গুলো অন্য গ্রহের ছবি সংগ্রহ করছে, আবার কোন গুলো পৃথিবীর ছবি তুলছে এবং কোনটা আবার আবহাওয়ার পুর্বাভাস দিতে হারিকেনের গতিপতের উপর নজর রাখতে আবহাওয়াবিদকে সর্বক্ষণ সহায়তা করছে। স্যাটেলােইট এগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দূর্যোগের আভাস দিতেও সহায়তা করে আসছে। এগুলো ছাড়াও কিছু কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে যেগুলা মূলত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বজুড়ে ফোন কল সংযোগ স্থাপন সহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।

পৃথিবী থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে পাঠানো তথ্য গুলো স্যাটেলাইট গ্রহণ করে এবং বিবর্ধিত (এমপ্লিফাই) করে পৃথিবীতে পুনরায় কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করে। স্যাটেলাইট দুটি আলাদা তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগন্যাল (তথ্য) পাঠানো ও গ্রহণ করার জন্য। কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা পৃথিবীতে আশা সিগন্যাল অনেক কম শক্তিসম্পন্ন বা দুর্বল হয়ে থাকে এবং এর জন্য প্রথমে ডিস অ্যান্টিনা ব্যবহার করে সিগন্যালকে কেন্দ্রভূত করা হয় এবং পরে তা রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হয়।

স্পেস এক্স কি? স্পেস এক্স এর অজানা ইতিহাস

অ্যান্টেনা

অ্যান্টেনা তথ্য গ্রহণ ও প্রেরণ এর কাজকর্ম করে থাকে। মূলত পৃথিবী থেকে তথ্য আদান-প্রদান এর কাজ করে। অ্যান্টেনার বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। যেমন- প্রতিফলক, মাইক্রোস্ট্রিপ, মনোপোল, পারাবোলিক ও ডিপোল হর্ণ ইত্যাদি। অ্যান্টেনার ধরন মূলত নির্ভর করে কৃত্রিম উপগ্রহে ব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশনের উপর।

সৌর কোষ এবং ব্যাটারী ব্যাকআপ

ব্যাটারী ও সোলার প্যানেল স্যাটেলাইটের একমাত্র শক্তির উৎস। সোলার প্যানেল গুলো আলোক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর করে ও ব্যবহাররের পাশাপাশি ব্যটারিতে সংরক্ষণ করে। সোলার সেল সূর্যালোকের উপস্থিতিতে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে এবং যদি সূর্যালোক না থাকে তাহলে ব্যটারি শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।

Leave a Reply