গ্রাফিক্স ডিজাইনার রেজাউল করিমের সফলতার গল্প

আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন

আমি মোঃ রেজাউল করিম তালুকদার ,বগুড়া শহরের পশ্চিমে শিবগঞ্জ উপজেলাধীন পিরব গ্রামে আমার জন্মস্থান।  ২০১২ সাল থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে কাজ করছি জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস ইনভাটো , ক্রিয়েটিভ মার্কেট এবং আপওয়ার্ক এ পাশাপাশি একটি গ্রাফিক্স ডিজাইন ফার্ম করেছি যেখানে ১০ জন তরুণ ছেলেরা কাজ শিখতেছে। 

অনলাইনে যে ইনকাম করা যায় এটা প্রথম কিভাবে জেনেছেন?

২০০৮ সালে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারি অনলাইনে কাজ করে টাকা ইনকাম করা যায়। তার কাছে কিছু দিন কাজ করা দেখে এই কাজ শুরু করা। 

কোথায় থেকে, কিভাবে কাজ শিখলেন?

আমি মূলত ২০০২ সালে পড়াশোনার জন্য বগুড়া শহরে এসেছিলাম। বগুড়াতে আমার পরিচিত একটা মামার বাসায় থাকতাম তার প্রচারণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তার প্রতিষ্ঠানে আমি পড়াশোনার পাশাপাশি গ্রাফিক্স  ডিজাইন প্রাকটিস করতাম। সেখানে আমি গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করি ২০০২ সনে, প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছি সেখানে।

কিন্তু তখন আমার ইচ্ছা থাকার পরেও ২০১০ সালে আমি অনলাইনে কাজ করার সময় পেতাম না।  কারণ সেই প্রতিষ্ঠানে কাজের চাপ অনেক বেশি ছিল। ২০১১ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে অনলাইনে কাজ করতে হবে। তখন ডিজাইনএক্সপ্রেস নামে আমার একটা প্রচারণা প্রতিষ্ঠা গড়ে তুলেছিলাম । কিন্তু সেখানে খুব বেশি সময় দিতাম না সেই প্রচারণা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার বন্ধু কাজ করত আমি বসে বসে তার কাজ করা দেখতাম, আমি যেহেতু আগে থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে কাজ করেছি তাই কাজ বুঝতে বেশি সময় লাগে নাই,  তারপর একটা একাউন্ট করি ইনভাটোতে আর তখন থেকেই চলছে।

প্রথম দিকে কাজ করতে গিয়ে কি কি অসুবিধায় পড়েছেন?

নতুন অবস্থায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে প্রথম যে সমস্যা টা ছিল আমি যেহেতু লোকাল মার্কেটে কাজ করেছি (প্রেসে) যে কারণে আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইন সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিলনা । ডিজাইনে কি রকম কালার ব্যবহার করবো, কি ধরণের ডিজাইন করলে ভালো সেল পাবো এরকম কোনো ধারণা ছিল না।

 কোনো রিসোর্চ প্রয়োজন হলে কোথায় পাবো বা কোথায় খুঁজবো সেরকম কোনো ধারণা ছিল না পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, তখন থেকে  ডিজাইন করতে গেলে ভালো কোয়ালিটি ছবি লাগবে আইকন লাগবে এগুলো তখন নিজে তৈরি করতাম, গুগল থেকে ফ্রি ছবি ডাউনলোড করে ব্যবহার করতাম, বিভিন্ন কারণে কাজ রিজেক্ট হত। আর সর্বোপরি ইন্টারনেট ব্যাবস্তা ভালো ছিল না, তখন ভালো উপার্জন ছিল না, অনেক কম বেতনে চাকরি করতাম , যে কারণে ইন্টারনেট এম বি কেনার টাকাও কাছে ছিল না, খুব কষ্ট করে মডেম কিনে এম বি কিনে কাজ করতাম, পেমেন্ট গেটওয়ে নিয়েও সমস্যা ছিলো।

সফলতা পেলেন কবে এবং কিভাবে?

২০১২ সালের শেষের দিকে অনেক কিছু বুঝে ওঠি তখন থেকে অনেক সময় দিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। আমি সময় দিয়ে কাজ করতাম , কোয়ান্টিটি কম করে কোয়ালিটি সম্পূর্ণ কাজ করতাম। প্রিন টেম্পলেট এর পাশা পাশি ব্র্যান্ডিং ডিজাইন এবং পাওয়ারপয়েন্ট ডিজাইন শুরু করি ২ বছর পরিশ্রম করে এনভাটোতে এলিট অথর হয়েছিলাম, তখন দীর্ঘ ৪ বছর ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমার ৩ টা  প্রোডাক্ট সাপ্তাহিক পপুলারে  থাকতো,  (আলহামদুলিল্লাহ ) নিজের সফলতা শুরু হতে থাকে, এর মাঝে ২০১৪ সালে বেসিস আউটসোর্চিং অ্যাওয়ার্ড পাই। ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল উনিভার্সিটি থেকে একটা সম্মাননা পাই। আইসিটি  মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রিল্যান্সারদের সম্মাননা প্রদান করেন সেখানে আমাকে ইনভাইট করেছিল। ২০১৬ সালে বগুড়া থেকে  লার্নিং এন্ড আর্নিং অ্যাওয়ার্ড মেলায় প্রথম স্থান হয়ে একটি ল্যাপটপ উপহার পাই।

এখন বর্তমানে কি করছেন?

বর্তমান পাওয়ারপয়েন্ট নিয়ে কাজ করছি, ২ টা এজেন্সির সাথে আছি আপওয়ার্ক এর মাধ্যমে আর একটা টিম নিয়ে কাজ করছি যেখানে নিজের একটা কোম্পানি দাড় করানোর চেষ্টাই আছি।

আপনি কি নিজেকে সফল মনে করেন?

আলহামদুলিল্লাহ সফলতার একটা পর্যায়ে আছি বলে  আমার মনে হয়। গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং এর ক্যারিয়ার হিসাব করলে ৮ বছর জীবনে অনেক পরিবর্তন করেছি।  যা অন্য কোন পেশায় থেকে হয়তো করা সম্ভব ছিল না এটা আমি উপলব্ধি করতে পারি , কেননা আমার শুরুটা ছিল একটা প্রচারণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম সেখানে নাম মাত্র বেতন পেতাম। আমার কাছের অনেক ভাই ব্রাদারকে প্রতিষ্ঠিত করেছি , তারা এখন সফলতার সাথে ফ্রিল্যান্সিং করছে, এক কথায় বলা চলে আমি শুধু নিজেই সফল হয়েছি  এমনটা নয় পাশাপাশি আরো কিছু নতুনদের সফলতার কাছে নিয়ে এসেছি, যা  আমি মনে করি আমার সফলতার অংশ।

গ্রাফিক্স ডিজাইন সেক্টরে বাংলাদেশিদের অবস্থান কোথায়?

গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে আউটসোর্সিং এ বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। কাজের জন্য নতুনদের উৎসাহ দিয়ে কাজ করাতে পারলে অনেক ভালো একটা অবস্থান তৈরি হবে। মার্কেটপ্লেস গুলোতে নতুনদের জন্য অনেক ভালো কিছু আছে , কিন্তু আনপ্রোফেশনালিসম এর কারণে মার্কেটের ক্ষতি হচ্ছে যা নতুনদের জন্য আরো কঠিন হবে।  

কিন্তু নতুনদের উদ্দেশ্য অনেক কিছু বলার আছে , উপার্জন করার আশায় স্কিল ডেভেলোপ না করে তাড়াহুড়া করে মার্কেটপ্লেসে চলে আসলে কিন্তু কাজ হবে না, একমাত্র সঠিক স্কিল দ্বারাই উপার্জন করা সম্ভব।  অনেক কারণে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার কে হায়ার করতে চায় না তার একটা কারণ হচ্ছে , কাজের সময় এবং কাস্টমারের রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করতে না পাড়া ( এতে  নতুনদের জন্য কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে ) সুতরাং স্কিল অর্জন করে তারপর কাজ করতে হবে।

আপনি কি টিম ভিত্তিক কাজ করেন? কিভাবে টিম গড়ালেন? কিভাবে টিম মেইন্টেইন করেন?

নিজে কাজ করি পাশাপাশি টিম আছে, এখন বর্তমানে ১০ জন কাজ করে আমার টিমে।  সবাইকে শুরু থেকে কাজ শিখিয়ে নিয়েছি তাদের কে একটা ভালো সময় দিয়ে কাজ শিখিয়েছি, যারা কাজে খুব আগ্রহী তাদের কে দিয়ে টিম করেছি,  যদিও নতুনদের সংখ্যা বেশি আমার টিমে। মাসিক স্যালারি এবং কমিশন বেসড পেমেন্ট করে থাকি, অফিসের সবাইকে ভাই ব্রাদার হিসাবে নিয়ে থাকি।  সবার ভালো মন্দ দেখভাল করি,  টিম মেম্বারদের  নিয়ে বিভিন্ন সময় ট্যুর পিকনিক করে থাকি। 

আপনার দৃষ্টিতে এই সেক্টরের ভবিষ্যৎ কেমন?

এই সেক্টরের ভবিষ্যত অনেক ভালো।  মানুষ কম সময়ে আর সহজে সব কিছু পেতে চায়. বহির্বিশ্বের সকল ধনী রাষ্ট্রে সময় মূল্য দিতে জানে যে কারণের আমাদের মতো দেশের মানুষকে তারা কম টাকায় খাটিয়ে নিতে পারে , তাদের কাছে কম টাকা হলেও আমাদের কাছে তা অনেক বেশি। বেকারত্ব দূর করতে ইন্টারনেট ভিত্তিক এসকল কাজ আরো সহজে করার জন্য সরকারি সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেক শিক্ষিত যুবক যারা কম্পিউটার কিনে কাজ করবে এমন সক্ষমতা নেই তাই তাদের কে সরকারিভাবে আইটি ফার্ম করে প্রশিক্ষণ এবং  চাকুরীর ব্যবস্থা করতে হবে।   

যারা নতুন শুরু করতে চায় তারা কিভাবে শুরু করতে পারে?

এই কাজ শুরু করতে চাইলে নতুনদের আগে চিন্তা করতে হবে, ভালো মানের স্কিল অর্জন করবো। সময় নিয়ে কাজ শিখতে হবে ।  আগে আমরা ১০ টা টেম্পলেট ডিজাইন করে যে টাকা উপার্জন করেছি এখন ৩০ টা টেম্পলেটে ডিজাইন করে সেই উপার্জন করতে হয়। সুতরাং মার্কেটপ্লেসে কম্পিটিশন বেড়ে গিয়েছে।  নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে তাহলে কাজ করতে পারবে ।

আপনি নিজেকে ৫ বছর পর কোন পর্যায়ে দেখতে চান? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

স্বপ্ন অনেক বড় আল্লাহতালা যদি পূরণ করে, নিজের একটা আন্তর্জাতিক মানের আইটি ফার্ম থাকবে, যেখানে অনেক কর্ম সংস্থান হবে। এক কথায় জীবনে আরো অনেক কিছু করা বাকি আছে যেখানে নিজের স্বপ্নের সাথে দেশের তরুণদের নিয়ে যেতে হবে বহুদূর। 

পরিকল্পনা করেছি অনেক আগেই এখন বাস্তবায়ন করতে হবে, ফ্রিল্যান্সিং এর পাশা পাশি মাছ চাষ এবং বাগান করা আমার খুব শখ। জীবনকে কিছু দিতে চাইলে ভ্রমণ করতে হবে আমি খুব ভ্রমণ পিপাসু বলতে পারেন। 

[একটা অন্যরকম প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবেন না]

আপনার কাছে কি মনে হয় যে অনলাইন প্রফেশনাল রা কোন ভাবে সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে আছে? কি কি করলে অনলাইন প্রফেশনালদের সামাজিক মর্যাদা বাড়তে পারে বলে আপনার মনে হয়?

সামাজিক মর্যাদায় একটু পিছিয়ে আছে তার কারণ হচ্ছে,  আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতার কারণ, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জ্ঞান নেই বললেই চলে, যে কারণে খুব কম মূল্যয়ন করে। ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে প্রচারণা শুরু হয়েছে ৫ বছর আগে থেকে তাই অন্তত ১ যুগ পর এ বিষয়ে বাস্তব মুখী হবে মানুষ। সরকারি ভাবে এটাকে প্রফেশন  বানিয়ে মানুষকে জানাতে হবে তাহলে একসময় সামাজিক মর্যাদা বাড়বে।  যদিও সেটা সময়ের ব্যাপার। 

এই কাজ গুলো কি শুধু মার্কেটপ্লেস ভিত্তিক? নাকি বাহিরেও করা সম্ভব? সম্ভব হলে কিভাবে বাহিরে থেকে কাজ ধরা যেতে পারে?

নতুনদের জন্য মার্কেটপ্লেস এর বিকল্প নেই , তবে যারা অভিজ্ঞ তাদের বিষয়টা আলাদা।  সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন পোর্টফোলিও সাইট দিয়ে ডিজিটাল মার্কেটিং এর সাহায্যে কাজ নিতে পারবে এবং কাজ করতে পারবে। লিংকডইন এর সাহায্যে  কাজ নিতে পারবে , বিহান্সে পোর্টফোলিও তৈরি করে কাজ নিতে পারবে।  ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলে বিভিন্ন সুযোগ আসবে যেগুলো মার্কেটপ্লেস বাহিরে করা সম্ভব।

বাংলাদেশে যারা আপনার সেক্টরে কাজ করছে তাদের ব্যাপারে সর্বশেষ কিছু উপদেশ দিন

আমি গ্রাফিক্স  নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করি এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা জানাতে পারি উপদেশ বা পরামর্শ হিসাবে নিতে পারেন। এ সেক্টরে কাজ করতে চাইলে প্রথমে আপনাকে কাজের প্রতি অনেক মনযোগী হতে হবে  এবং ইউনিক ডিজাইন করতে হবে। কোয়ালিটি ভালো হতে হবে কোয়ান্টিটি কম হয়ে ভালো কোয়ালিটি ডিজাইন করতে হবে। আপনাকে মাথায় রাখতে হবে গ্রাফিক্স ডিজাইন একটা শিল্প এখানে কম সময়ে বেশি কাজ করবেন এমন চিন্তা ভাবনা থাকলে সেটা ভালো হবে না। কাস্টমারের রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করতে হবে সেখানে নিজের সেরা তা দিতে হবে 

বাতিস্তা কিভাবে তার অনলাইন জার্নি শুরু করেছিলো?

7 thoughts on “গ্রাফিক্স ডিজাইনার রেজাউল করিমের সফলতার গল্প”

Leave a Reply