কালের ধারাবাহিকতায় ও যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে সর্বত্র। অফিস, আদালত, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজন অথবা বিনোদনের তাগিদে ইন্টারনেট দৈনন্দিন জীবনে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে পরিগণিত।
যে কারণে নেট স্পীড বা ইন্টারনেট স্পীড যা-ই বলি না কেন, তা এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ 2G, 3G ছাপিয়ে এখন 4G ইন্টারনেট স্পীড তার গতিময়তা ছড়িয়ে চলেছে সবখানে। কোথাও কোথাও তো ইতিমধ্যে সুপার ফাস্ট 5G ইন্টারনেট স্পীডেরও দেখা মিলছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এটাই যে, বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীগণ-কে নেট স্পীড সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এবং এর পরিমাপ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার ফলে বিভিন্ন telecom company বা broadband servicing কোম্পানির গুলোর চতুরতার কাছে ঠকে যেতে হয়।
কেননা প্রায় সময়ই আমরা বুঝতে পারিনা যে, আমাদের কে ঠিক যতটুকু ইন্টারনেট স্পীডের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ঠিক ততটুকু স্পীড আমরা পাচ্ছি কিনা।
আর এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায় হলো ইন্টারনেট এর গতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং এটি পরিমাপ করার উপায় সম্পর্কে জানা। কিন্তু শক্তিশালী সোর্সের অভাবে হয়তো আমরা অনেকেই এখনও এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানিনা এবং বুঝি না।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে আজকের ব্লগে আলোচনা করা হবে, নেট স্পীড কি, নেট স্পীড কিভাবে ও কেন পরিমাপ করা হয় এবং ৫ টি জনপ্রিয় ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট টুলস এর A-Z সবকিছু।
সুতরাং আর্টিকেলটির শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ড খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। কেননা এর প্রতিটি অংশ-ই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যবহুল।
WiFi কি? ওয়াইফাই কিভাবে কাজ করে?
নেট স্পীড টেস্ট
নেট স্পীড টেস্ট বিষয়ক আলোচনা শুরুর পূর্বে আমরা জানে নেব নেট স্পীড কি। কেননা আমরা অনেকেই হয়তো এ বিষয়টি অলরেডি জেনে থাকবো কিন্তু অনেকেই আবার নাও জানতে পারে। তাহলে চলুন এ পর্যায়ে জেনে নেয়া যাক নেট স্পিড বা ইন্টারনেট স্পীড কি?
“সাধারণত নেট স্পীড (net speed) হলো ইন্টারনেট এর দ্রুততার একটি পরিমাপক যার থেকে বোঝা যায় যে, ডিভাইসে ইন্টারনেট কানেকশন থাকা অবস্থায় ঠিক কতখানি স্পীডে ইন্টারনেট থেকে কোন ডেটা (data) বা ফাইল (file) ডাউনলোড বা আপলোড করা যায়।”
নেট স্পীড পরিমাপ করা হয় সাধারণত এমবিপিএস (Mbps) হিসেবে। এখানে Mbps হলো মেগাবিটস পার সেকেন্ড (Megabits Per Second)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যার দ্বারা বোঝানো হয় যে, প্রতি সেকেন্ডে কত মেগাবিট (Megabit) ডেটা বা ফাইল ডাউনলোড বা আপলোড হয়।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি 600mb সাইজের একটি ভিডিও ফাইল ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করবেন। সে সময় দেখা গেল আপনার ইন্টারনেটের ডাউনলোড স্পিড 20 Mbps. যার মানে হলো প্রতি সেকেন্ডে আপনার ডিভাইসে 20mb ডেটা ডাউনলোড হতে পারবে।
তাই দেখা যাচ্ছে, 600mb ভিডিও ডাউনলোড হতে টোটাল সময় লাগছে প্রায় ৩০ সেকেন্ড বা আধা মিনিট।
আর যদি আপনার নেটের স্পীড 10 Mbps হতো তাহলে একই সাইজের ভিডিও-টি ডাউনলোড হতে সময় লাগতো প্রায় 60 সেকেন্ড বা এক মিনিট।
সুতরাং এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আপনার নেটের এমবিপিএস (Mbps) যত বেশি হবে, নেটের স্পীডও তত বেশি হবে। অর্থাৎ Mbps যত বেশি হবে ইন্টারনেট থেকে কোন ডেটা (data) বা ফাইল তত দ্রুত ডাউনলোড (download) বা আপলোড (upload) হবে।
তো এতক্ষণ আমরা জানলাম নেট স্পীড কি। এখন আমরা জানব নেট স্পীড টেস্ট কি।
“নেট স্পীড টেস্ট হলো ইন্টারনেট সংযুক্ত কোন ডিভাইসে কতটুকু স্পীডে কোন ডেটা বা ফাইল ডাউনলোড অথবা আপলোড হচ্ছে তা পরীক্ষা (test) করা।”
আমরা যখন কোন টেলিকম কোম্পানি কিংবা ব্রডব্যান্ড অপারেটরের নিকট থেকে ইন্টারনেট ক্রয় করি, তখন তাঁরা 10 Mbps, 20 Mbps, 40 Mbps, 100 Mbps, এমনকি 200 Mbps পর্যন্ত সুপার ফাস্ট স্পীডের ইন্টারনেট অফার করে। আর আমরা গ্রহকগণ বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও লোভনীয় অফারে মোহিত হয়ে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে সেই ইন্টারনেট ক্রয় করি।
কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে, অপারেটররা যেই স্পীডের ইন্টারনেট সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছেন, ঠিক সেই স্পীডের ইন্টারনেট আমরা পাচ্ছি কিনা?
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী-ই এই বিষয়টি জানেন না এবং ফলশ্রুতিতে অপারেটরদের নিকট প্রতিনিয়ত ঠকে যান। অর্থাৎ যে পরিমাণ স্পীডের ইন্টারনেট সরবরাহ করার কথা বলা হয়, তাঁরা সেই পরিমাণ স্পীডে ইন্টারনেট সরবরাহ করেন না।
তাই এই বিষয়টি চেক করার জন্য আমাদের ইন্টারনেট স্পীড টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। নেট স্পীড টেস্টের মাধ্যমে আমরা সহজেই জানতে পারি যে, আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছি তার স্পীড বা গতি কতটুকু এবং আমাদের প্রত্যাশা ও তাঁদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তা কি ঠিক আছে কিনা। আর যদি ঠিক না থাকে তাহলে চাইলেই আমরা তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।
অর্থাৎ অন্ততপক্ষে অপারেটরদের কাছে আমাদের আর ঠকে যেতে হবে না। কিন্তু এর জন্য যে বিষয়টি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নেট স্পীড কিভাবে টেস্ট করা যায় তা জানা।
যদিও নেট স্পীড টেস্ট করা খুবই সহজ একটি বিষয়, কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে এটি কিভাবে করতে হয়। তাই আজকে আমরা জানব যে কিভাবে নেট স্পীড টেস্ট করা যায়।
কয়েকটি খুবই সহজ কিন্তু শতভাগ কার্যকরী টুলস এর সাহায্যে আপনারা এই কাজটি যেকোন সময় যেকোন জায়গা থেকে নিজে নিজেই করে নিতে পারবেন। কিন্তু আপনারা অনেকেই হয়তো এই টুলস গুলোর নাম জানেন না কিংবা ব্যবহার করতে জানেন না।
তাই আর্টিকেল-এর এই পর্যায়ে আমি আলোচনা করব সেরা ৫ টি নেট স্পীড টুলস নিয়ে। যেগুলোর সাহায্যে আপনি খুব সহজেই আপনার ইন্টারনেট স্পীড চেক করে নিতে পারবেন।
৫ টি ইন্টারনেট স্পীড টেস্ট টুলস
ইন্টারনেটে সার্চ করলে আপনি অসংখ্য নেট স্পীড টেস্ট টুলের সন্ধান পাবেন। কিন্তু এদের সবকয়টি ইউজার ফ্রেন্ডলি নয় এবং আপনাকে সঠিক রেজাল্ট প্রদান করবে না।
তাই নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বিভিন্ন অনলাইন রিভিউ রিসার্চের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া সবথেকে সেরা এবং নির্ভরযোগ্য ৫ টি অনলাইন ইন্টারনেট স্পীড টেস্ট টুলস নিয়ে এখন আলোচনা করব।
সুতরাং চলুন দেখে নেই ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করার জন্য সেরা ৫ টি অনলাইন টুলস কি কি।
ফাস্ট ডট কম (fast.com)
ইন্টারনেট স্পীড চেক করার জন্য যতগুলো অনলাইন টুলস রয়েছে তাদের মাঝে fast.com সবথেকে নির্ভরযোগ্য এবং জনপ্রিয় একটি টুল।
এই টুলটির মাধ্যমে আপনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আপনার ব্যবহৃত ইন্টারনেটের স্পীড চেক করতে পারবেন। এক ক্লিকে ওয়েবসাইটটি তে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আপনার ডিভাইসের ইন্টারনেট স্পীড চেকিং প্রসেস শুরু হয়ে যাবে।
এরপর কিছু সময় পরেই আপনার ডিভাইসের স্ক্রিনে বোল্ড অক্ষরে নেট স্পীডের ফাইনাল রেজাল্ট দেখিয়ে দেবে।
স্পিড টেস্ট ডট নেট (speedtest.net)
নেট স্পীড চেক করার ক্ষেত্রে speedtest.net আরেকটি সেরা এবং জনপ্রিয় অনলাইন টুল। এটিকে অনেকে স্পীড টেস্ট বাই ওকলা (speedtest by ookla) নামেও চিনে থাকে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে এই অনলাইন টুলটির রয়েছে হাজার হাজার ব্যবহারকারী। এমনকি আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এই টুলটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
Speedtest by Ookla ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার পরে আপনার সামনে সাইটের হোম পেজটি ওপেন হবে। এই ওয়েবসাইটের আরেক অন্যতম ভালো দিক হলো, এর হোম পেজটি প্রায় শতভাগ ইউজার ফ্রেন্ডলি। যে কারণে এত অধিক সংখ্যক ব্যবহারকারী এই টুলটি পছন্দ করে থাকেন।
এখন সাইটের হোম পেজে নিচের চিত্রের ন্যায় একটি Go বাটন দেখতে পাবেন।
এরপর বাটনটি-তে ক্লিক করুন। বাটনটিতে ক্লিক করা মাত্রই আপনার ইন্টারনেটের স্পীড চেকিং শুরু হয়ে যাবে এবং এর কিছুক্ষণের মাঝেই আপনি আপনার ডিভাইসের স্ক্রিনে তার ফাইনাল রেজাল্ট দেখতে পাবেন।
ব্যান্ডউইথ প্লেস ডট কম (bandwidthplace.com)
ইন্টারনেট এর গতি পরীক্ষার জন্য bandwidthplace.com আরেকটি নির্ভরযোগ্য অনলাইন নেট স্পীড টেস্ট টুল। সঠিক তথ্য সরবরাহের জন্য এই টুলটি এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিকেট বেশ সমাদৃত।
bandwidthplace.com ওয়েবসাইটটি-তে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছবির মতো একটি start বাটন দেখতে পাবেন।
এরপর এই বাটনে ক্লিক করার কিছু সময় বাদেই আপনি আপনার ইন্টারনেটের ডাউনলোড স্পীড (download speed), আপলোড স্পীড (upload speed) এবং পিং (Ping) আলাদা আলাদাভাবে জেনে নিতে পারবেন।
স্পীডচেক ডট অরগানাইজেশন (speedcheck.org)
ইন্টারনেট স্পীড চেক করার জন্য speedcheck.org অন্যতম সেরা এবং জনপ্রিয় একটি অনলাইন নেট স্পীড চেকিং টুল। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ব্যবহারকারী তাদের ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করার জন্য এই টুলটির ওপর ভরসা করে থাকেন।
এই টুলটির সাহায্যে ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করার জন্য প্রথমে আপনাকে এর ওয়েবসাইটে (speedcheck.org) প্রবেশ করতে হবে।
এরপর সেখান থেকে “start test” বাটনটি-তে ক্লিক করতে হবে। বাটনটিতে ক্লিক করার কয়েক সেকেন্ড এর ভিতরেই আপনাকে আপনার ইন্টারনেটের প্রকৃত স্পীডের রেজাল্ট দিয়ে দেয়া হবে।
টেস্ট মাই ডট নেট (testmy.net)
টেস্ট মাই ডট নেট ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষার জন্য আরেকটি নির্ভরযোগ্য অনলাইন টুল যেটি খুব সহজে এবং অনেক অল্প সময়ের মাঝে ইন্টারনেট স্পীড চেক করার সুবিধা প্রদান করবে।
এই ওয়েবসাইটের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেটি হলো, এটি তার সমস্ত তথ্য খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে তার ইউজারের নিকট পেশ করে থাকে। এককথায় বলতে গেলে এই ওয়েবসাইটটি কে আপনি শতভাগ ইউজার ফ্রেন্ডলি হিসেবে পাবেন।
TestMy.Net-এ প্রবেশ করার পর এর হোম পেজে Test My Download Speed, Test My Upload Speed এবং Automatic Speed Test নামক ৩ টি অপশন দেখতে পাবেন। এখান থেকে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোন একটি অপশনে ক্লিক করে আপনার ইন্টারনেটের গতি কেমন তা জেনে নিতে পারবেন।
সম্মানিত পাঠক! এ পর্যায়ে আমরা আমাদের আর্টিকেলের একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। এতক্ষণ আমরা নেট স্পীড কি এবং নেট স্পীড চেক করার সেরা ৫ টি অনলাইন টুল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম।
তবে এক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বিষয় আমাদের জেনে রাখা জরুরি। যেমন- ইন্টারনেট স্পীড চেক করার সময় অবশ্যই আপনার ডিভাইস ইন্টারনেট কানেকশন চালু করা থাকতে হবে। নতুবা আপনি নেট স্পীড টেস্ট করতে ব্যর্থ হবেন।
এছাড়া যেকোন একটি টুল ব্যবহার না করে একসঙ্গে কয়েকটি টুলের সাহায্য নিন। কেননা একটি টুল সবসময় শতভাগ সঠিক তথ্য আপনাকে নাও দিতে পারে। তাই আপনি যদি একাধিক টুলের সাহায্য নিয়ে থাকেন তবে খুব সহজেই আপনি আপনার ইন্টারনেটের সঠিক গতি সম্বন্ধে জানতে পারবেন।
তাছাড়া এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। তা হলো ইন্টারনেটের স্পীড সবসময় একরকম পাবেন না। কেননা স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেটের স্পীড আপ-ডাউন করতে পারে। তাই নিয়মিত আপনার ইন্টারনেটের স্পীড চেক করতে পারেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে পছন্দমত যেকোন টুল ব্যবহার করতে পারেন।