ওয়াইফাই

WiFi কি? ওয়াইফাই কিভাবে কাজ করে?

আধুনিক টেকনোলজি সারা বিশ্বের প্রতিটি সেক্টরকে করেছে উন্নত এবং সেইসাথে তাদের ব্যবহার শৈলিতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। বহু বছর পূর্বে যখন ইন্টারনেট আবিষ্কার হয় তখন সুনির্দিষ্ট কিছু ডিভাইসে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এর জন্য প্রয়োজন ছিল ক্যাবল সংযোগ। 

কিন্তু এই ক্যাবল সংযোগগুলো ছিল অনেক ভোগান্তির বিষয়। গ্রাহকদের প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। তাছাড়া এভাবে ইন্টারনেট সংযোগ করা ছিল কিছু কিছু ডিভাইসের জন্য সীমাবদ্ধ।

তবে অবশেষে ১৯৯৮ সালে ওয়াইফাই টেকনোলজি আবিষ্কার হওয়ার পর সারা বিশ্বে প্রযুক্তির এক নতুন দ্বার উন্মোচন হয়। এরপর সময়ের সাথে ওয়াইফাই বা তারবিহীন নেটওয়ার্ক সংযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা কেবল বেড়েছেই। 

বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি স্মার্ট  ডিভাইসেই রয়েছে ওয়াইফাই সংযোগের ব্যবস্থা। আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাড়িয়েছে এই ওয়াইফাই (Wi-Fi) টেকনোলজি। তাই ওয়াইফাই বিষয়টি জানার ও শেখার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহও অনেক।

তাই আজকের ব্লগে আলোচনা করা হবে, ওয়াইফাই কি, ওয়াইফাই কিভাবে কাজ করে, ওয়াইফাই এমবিপিএস কি সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে। তাহলে চলুন মূল কথায় যাওয়া যাক।

ওয়াইফাই কি?

ওয়াইফাই (wi-fi) হলো একপ্রকার তারবিহীন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ( Wireless Network Technology) যার সাহায্যে দুই বা ততোধিক কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের মধ্যে ইন্টারনেট বা ডেটা আদানপ্রদান এর সুযোগ তৈরি হয়। 

অর্থাৎ যেই প্রযুক্তির সাহায্যে কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং এরূপ অন্যান্য বৈদ্যুতিক ডিজিটাল ডিভাইস গুলোতে তারবিহীন উপায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয় তাকে ওয়াইফাই প্রযুক্তি বলা হয়।

ওয়াইফাই (Wi-Fi)-এর পূর্ণরূপ হলো Wireless Fidelity। যা wireless networking technology ব্যবহার করে বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে ডাটা বা ফাইল শেয়ার করে। ওয়াইফাই এই কাজটি মূলত অন্যান্য ওয়্যারলেস প্রযুক্তির ন্যায় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের মাধ্যমে করে থাকে।

দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের কারণে সারাবিশ্বে ওয়াইফাই এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অফিস, বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শপিং মল এবং এয়ারপোর্ট সহ প্রায় প্রতিটি স্থানেই রয়েছে ওয়াইফাই সুবিধা।

বর্তমানে প্রায় সকল কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট স্পিকার্স, প্রিন্টার, গাড়ি এবং ড্রোন ডিভাইস Wi-Fi টেকনোলজির অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮ সালের এক হিসেব অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ২.৯৭ বিলিয়নের উপরে ডিভাইসে ওয়াইফাই প্রযুক্তি চালু হয়। 

ওয়াইফাই খুব অল্প সময়ে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ওয়াইফাই জোনে থাকা ডিভাইসগুলোর মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। এর জন্য প্রতিটি ডিভাইসেই দেওয়া রয়েছে ওয়াইফাই অ্যাডাপ্টার বা ওয়াইফাই চিপ। যেটি রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে ওয়াইফাই রাইটারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ডেটা গ্রহণ করে থাকে। 

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, “ওয়াইফাই হলো একটি তারবিহীন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি যেটি তারের পরিবর্তে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে দুই বা ততোধিক ডিভাইসকে ইন্টারনেট এর সাহায্যে নিজেদের মধ্যে যুক্ত করে এবং তথ্য আদান-প্রদান করে” । 

ওয়াইফাই (wi-fi) কিভাবে কাজ করে?

আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছি যে, ওয়াইফাই প্রযুক্তি নেটওয়ার্ক এর রেডিও তরঙ্গ (Radio Frequency) ব্যবহার করে কাজ করে। অর্থাৎ ওয়াইফাই জোনে অবস্থান করা ডিভাইসগুলোর মধ্যে ডেটা বা ইনফরমেশন প্রেরণ বা গ্রহণের জন্য সেই ডেটা বা ইনফরমেশন গুলোকে রেডিও সিগন্যালে রূপান্তর করা হয়। 

কোন একটি ডিভাইসকে ওয়াইফাই প্রযুক্তিতে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করার জন্য সেই ডিভাইসে পূর্বে থেকে অবশ্যই একটি ওয়্যারলেস এডাপ্টার (Wireless Adapter) সংযুক্ত থাকতে হয়। কেননা একটি wireless adapter এর মূল কাজই হলো নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে গ্রহণ করার তথ্য সমূহকে রেডিও সিগন্যাল (radio signal) আকারে গ্রহণ করা বা প্রেরণ করা। 

পূর্বে থেকে ওয়্যারলেস এডাপ্টার সংযুক্ত না থাকলে ঐ ডিভাইসের USB পোর্টের মাধ্যমে বাইরে থেকে এডাপ্টার সংযোগ দেয়া যায়। সাধারণত ব্যক্তিগত ডেস্কটপ গুলোতে USB পোর্টের সাহায্যে এডাপ্টার সংযোগ দিয়ে নিতে হয়। 

ওয়াইফাই টেকনোলজি সিস্টেমে একটি wi-fi জোন (jone)-এ অবস্থান করা ডিভাইস গুলোর মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের মধ্যমণি হিসেবে কাজ করে একটি ওয়্যারলেস রাউটার (Router). ওয়্যারলেস রাউটারের মূল কাজ হলো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রহণ করা তথ্যকে Radio Signal এ রূপান্তর করা। 

ওয়াইফাই প্রযুক্তি মূলত একটি দ্বিমুখী নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থাপনা। একে 2A রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম হিসাবেও ডাকা হয়। 

ওয়াইফাই কিভাবে কাজ করে এই বিষয়টিকে বোঝার জন্য এই 2A radio communication system-টি ভালোভাবে বোঝা দরকার। তাই এখন আমরা জানবো ওয়াইফাই কিভাবে 2A রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেমের আওতায় কাজ করে। 

সিস্টেম-১: এই পদ্ধতিতে ওয়্যারলেস এডাপ্টার সংযুক্ত একটি ডিভাইস যেমন-ডেস্কটপ প্রথমে নেটওয়ার্ক থেকে প্রাপ্ত নির্ধারিত ডেটাকে রেডিও তরঙ্গে রূপান্তর করে। 

এরপর সেই ডেটাকে ডিভাইসের এন্টেনার মাধ্যমে নিকটস্থ ওয়্যারলেস রাউটারে প্রেরণ করে। এখন রাউটার সেই ডেটাকে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং ডিকোডারের মাধ্যমে তথ্যকে ডিকোড করে ইথারনেট কানেকশন (Ethernet Connection) এর মাধ্যমে সেই তথ্যকে নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কে পৌঁছে দেয়। 

এভাবেই ওয়াইফাই প্রযুক্তির সাহায্যে ডেটা বা ইনফরমেশন রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে একটি ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে প্রেরিত হয়। 

সিস্টেম-২: এই সিস্টেমটি সিস্টেম-১ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এই পদ্ধতিতে একটি ওয়্যারলেস রাউটার তার নিকটস্থ ISP (Internet Service Provider)-এর পক্ষ থেকে সরবরাহকৃত ডেটা গ্রহণ করে এবং সেই ডেটা কে রেডিও signal-এ রূপান্তর করে নির্দিষ্ট ডিভাইসের ওয়্যারলেস এডাপ্টারে ট্রান্সমিট করে দেয়। 

আশা করি ওয়াইফাই প্রযুক্তির 2A রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেমটি বোঝাতে পেরেছি। ঠিক এই পদ্ধতিতেই আপনার আমার বাসায় কিংবা অফিসে লাগানো ওয়াইফাই প্রযুক্তি আমাদের ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, মোবাইল ফোন কিংবা স্মার্ট টিভিতে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকে।

তবে এখানে আমাদের আরও কয়েকটি বিষয় জেনে রাখা জরুরি, যেমন:

  • ওয়াইফাই প্রযুক্তির নির্ধারিত যন্ত্র সমূহের মাঝে ইন্টারনেট সংযোগ হলে তাদের নিজেদের মাঝে একটি নেটওয়ার্কিং এরিয়া WLAN (Wireless Local Area Network) তৈরি হয়। একে wi-fi jone-ও বলা হয়। 
  • ওয়াইফাই জোনের মধ্যে অবস্থান করা যে ডিভাইস গুলোর মধ্যে ওয়্যারলেস এডাপ্টার যুক্ত থাকে কেবল সেই ডিভাইস গুলোই ওয়াইফাই সিগন্যাল অ্যাক্সেস করতে পারবে।
  • ওয়াইফাই সিগন্যাল সর্বদা একটি নির্দিষ্ট এরিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঐ এরিয়ার বাহিরে কোন ডিভাইস চলে গেলে সেই ডিভাইস আর ঐ অঞ্চলের নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেস করতে পারবে না। 
  • একটি ডিভাইস ওয়াইফাই রাউটারের যত নিকটে অবস্থান করবে, সেই ডিভাইস তত বেশি গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করতে পারবে।
  • একইভাবে যে ডিভাইস রাউটারের যত দূরে থাকবে সেই ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগের গতি তত হ্রাস পাবে। 

ওয়াইফাই এমবিপিএস কি?

Megabits per second বা সংক্ষেপে Mbps (এমবিপিএস)- হলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার গতি বিষয়ক একটি পরিমাপক। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, এমবিপিএস হলো ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ এর একটি পরিমাপক। এখানে ব্যান্ডউইথ হলো আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইসের সর্বোচ্চ স্পিড যেই স্পিডে ইন্টারনেট থেকে কোন ডেটা আপনার ডিভাইসে ডাউনলোড হবে। 

আর ওয়াইফাই যেহেতু একটি ব্রডব্যান্ড টেকনোলজি তাই wi-fi এমবিপিএস (Mbps) বলতে বোঝায়, আপনার ওয়াইফাই জোনে আপনি প্রতি সেকেন্ডে কত বিটস ডাউনলোড এবং আপলোড স্পিড পাচ্ছেন। 

যেমন ধরুন, আপনি আপনার ডিভাইসে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে একটি ওয়েবসাইটে ভিজিট করলেন এবং সেখান থেকে আপনি একটি ভিডিও ডাউনলোড করতে চাইলেন। এখন ঠিক যেই স্পিডে সেই ভিডিও ফাইলটি আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইসে ডাউনলোড হবে, সেই স্পিডই হলো ব্যান্ডউইথ (Bandwidth) আর এমবিপিএস (Mbps) হলো সেই ব্যান্ডউইথ এর একটি পরিমাপক।

সাধারণত ব্যান্ডউইথ ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ স্পিডকে নির্দেশ করে। যেমন- ধরা যাক আপনার ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের স্পিড 100 Mbps. এর অর্থ হলো, আপনি এই নেটওয়ার্কের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ 100 megabits per second গতিতে ইন্টারনেট থেকে কোনো ফাইল ডাউনলোড, আপলোড কিংবা ব্রাউজ করতে পারবেন। 

আলাদা আলাদা ওয়াইফাই (wi-fi) নেটওয়ার্কের এমবিপিএস আলাদা আলাদা হতে পারে। যেমন- 1-5 Mbps ই-মেইল চেক এবং ওয়েব ব্রাউজিং এর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

আবার HD ভিডিও দেখার জন্য নূন্যতম 15-25 Mbps স্পিডের নেটওয়ার্কের দরকার হয়। আর যদি 4k ভিডিও ডাউনলোড কিংবা অনলাইন গেমস খেলার প্রয়োজন হয় তবে 40-100 Mbps স্পিডের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। 

আর এই সবকয়টি বিষয় যদি একসঙ্গে করতে চান এবং অনেক বড় বড় ফাইল ডাউনলোড করতে চান তাহলে 200+ Mbps স্পিডের ইন্টারনেট ব্যবহার করাই শ্রেয়। তবে সাধারণত ইন্টারনেটের আদর্শ স্পিড হিসেবে ধরা হয় 50 Mbps থেকে 100 Mbps গতিকে। 

ইতিকথা

এ পর্যায়ে আমরা আর্টিকেলের একদম শেষ প্রান্তে অবস্থান করছি। এতক্ষণ আমরা জানার চেষ্টা করলাম ওয়াইফাই কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি। 

ওয়াইফাই হলো এমন একটি ওয়্যারলেস টেকনোলজি যা বিশ্বের যে কোন প্রান্তে ওয়াইফাই জোনের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা যায়। যার ফলে খুব সহজেই বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজকর্ম সম্পাদন করা সহ মুহূর্তের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে প্রেরণ সম্ভব হচ্ছে।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিটি বিষয়ের যেমন একটি ভালো দিক রয়েছে তেমনি একটি খারাপ দিকও রয়েছে। যেমন: স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াইফাই টেকনোলজি যে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে তা মানবদেহের জন্য  অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং ক্যান্সারের একটি অন্যতম কারণ। তাই আমাদের উচিত হবে সবসময় ওয়াইফাই এর অতিরিক্ত ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন হওয়া। 

This Post Has 2 Comments

  1. Probodh and

    খুবই ভালো লাগলো। খুবই সহজে বুঝতে পারলাম। এজন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Reply