আমাদের প্রতিদিনের দরকারি কাজ কর্ম ইন্টারনেট অনেক সহজ করে দিয়েছে। এই কয়েক দশক আগেও এমন ছিল না। কিন্তু ২০ শতকে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজকের এই সফলতার পিছনে যত গুলো মানুষের হাত আছে তার মধ্যে জেফ বেজোস অন্যতম। তিনি বর্তমান সময়ের সবথেকে সফল উদ্যোক্তা এবং এই উদ্যোগ তাকে বিশ্বের সব থেকে বেশি সম্পদের মালিক বানিয়েছে। তিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য বেচা-কেনার সার্ভিস চালু করে, যাকে আমরা বর্তমানে অ্যামাজন হিসেবে জানি। আমাদের আজকের আলোচনায় আমরা অ্যামাজন কি, অ্যামাজন কীভাবে তৈরি হলো, অ্যামাজন কতো বড় এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে জানবো।
অ্যামাজন কি?
অ্যামাজন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জেফ বেজোস। তিনি ১৯৯৪ সালে সিয়্যাটলের তার নিজের বাড়ীর গ্যারেজে অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মূলত অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে পুরনো বই বিক্রি করার জন্য। কিন্তু অল্প সময়ে অনেক বেশি কাস্টমার হয়ে যাওয়ায় তিনি ব্যবসা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ধীরে ধীরে বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ, খাবার সহ সবকিছুই এখন অ্যামাজনে পাওয়া যায়। বর্তমানে অ্যামাজনে ১২ মিলিয়নের বেশি প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। মোট কথা কেনা যায় এমন সকল কিছুই অ্যামাজনে পাওয়া যায়।
বর্তমান সময়ে অ্যামাজন বিশ্বের সব থেকে বড় ইকমার্স প্লাটফর্ম, এর বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং একে আমেরিকার সব থেকে বেশি কর্মী ধারক বা কর্মচারী ওয়ালা কোম্পানি বলা হয়। এতে মোট ১০ লাখের মতো কর্মচারী কাজ করে। বিশ্বের সবথেকে বড় ওয়্যারহাউস যা ১ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট তা অ্যামাজনের। সবদিক বিবেচনা করে বলা হয় অ্যামাজন বিশ্বের সবথকে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত ইকমার্স প্রতিষ্ঠান এবং একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।
অ্যামাজন কিভাবে তৈরি হলো?
অ্যামাজন তৈরি হওয়ার পিছনে জেফ বেজোসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার হাত আছে। ব্যক্তিগত জীবনে জেফ বেজোস ছিলেন একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এর সুবাদে তার চাকরী জীবন শুরু হয় টেক কোম্পানি তে। তিনি কোন চাকরিতেই তেমন স্থায়ী হন নি। ধীরে ধীরে টেক রিলেটেড চাকরী ছেড়ে তিনি বিজনেস রিলেটেড কোম্পানিতে চাকরী করা শুরু করেন। এর পর তিনি ডি ই শ (deshow co) নামের একটি কোম্পানিতে চাকরী শুরু করেন।
কোম্পানিটি সাধারণত শেয়ার মার্কেটের জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম তৈরি এবং শেয়ার মার্কেট নিয়ে গবেষণা করতো। সেখানে তিনি বিজনেস সম্পর্কিত ধারণা লাভ করেন এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানে তার সহকর্মী হিসেবে কাজ করা তার বান্ধবী (পরবর্তীতে স্ত্রী) মাকেঞ্জি স্কট কে নিয়ে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার সিধান্ত নেয়। যদিও শ কোনোভাবেই তাদের ছেড়ে দিতে চায়নি। কিন্তু তারপরেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। চাকরী ছেড়ে দুইজনেই নিউ ইয়র্ক থেকে সিয়্যাটল রওনা হয়। এবং এই দীর্ঘ পথে বেজোস কি কি পণ্য বিক্রি করবে তার একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলে। বলে রাখা ভালো ওই সময় আমেরিকা সরকার ইন্টারনেটে বিক্রি পণ্যের ওপর ভ্যাট মাফ করে দিয়েছিল এবং বেসজ এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল। তিনি মোটামুটি ২০ টির মতো প্রোডাক্ট লিস্ট করেছিলেন এবং সব দিক বিবেচনা করে বই বিক্রির সিধান্ত নেয়।
যেহেতু নিজস্ব ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য এতো ফান্ড ছিল না তাই তিনি ফান্ড সংগ্রহ করা শুরু করে। এসময় তার মা এবং সৎ বাবা তাদের রিটায়ার্ড করার জন্য প্রাপ্ত অর্থ বেজোসকে দিয়ে দেয়। সকল সংগ্রহ করা অর্থ মিলিয়ে মোট ১ মিলিয়ন ডলার জমা হয় যা সম্পূর্ণটা তিনি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে।
তিনি তার গ্যারেজকে গোডাউন হিসেবে এবং তাদের থাকার দুইটি ঘরকে অ্যামাজনের জন্য ব্যবহার করা শুরু করে। অ্যামাজন যখন শুরু হয় তখন এর নাম ছিল ক্যাভাটার যার অর্থ ছিল মরদেহ। পরে আইনজীবীর সাথে আলাপ করে তিনি এই নাম বাদ দেয় এবং অ্যামাজন নাম নির্বাচন করে। অ্যামাজন নাম নির্বাচন করার আরও একটি কারণ আছে। অর্থাৎ আমরা Amazon নাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানকার A এবং Z নির্দেশ করে যে অ্যামাজনে A থেকে Z পর্যন্ত সকল প্রোডাক্ট পাওয়া যায়।
অ্যামাজন কত বড়?
অ্যামাজন বিশ্বের সবথেকে বড় ইকমার্স প্লাটফর্ম। এর বিস্তৃতি অনেক অনেক বড় এবং বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির লিস্টে প্রথমের দিকেই আছে, কারণ রেভিনিউ এর দিক থেকে অ্যামাজন অ্যাপল থেকে ছোট হলেও গুগল এবং ফেসবুক থেকে অনেক বড়। কর্মী হিসেব করলে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি যার প্রথমে আছে ওয়ালমার্ট কোম্পানি। সংখ্যায় ওয়ালমার্টের মোট কর্মী হলো ১.৫ মিলিয়ন অপরদিকে অ্যামাজনের হলো ১ মিলিয়ন। প্রতিবছর অ্যামাজন ব্ল্যাকফ্রাইডে উপলক্ষে ১ লক্ষ কর্মী সাময়িক নিয়োগ দেয়। কারণ এই সময় পণ্য বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের থেকে অনেক গুণ বেড়ে যায় যা সামাল দেওয়া খুব কঠিন।
অ্যামাজনের ২০২০ সালের নেট মূল্য ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কেবল অ্যাপলের থেকে ৫০০ বিলিয়ন কম। এর পরেই আছে গুগল এবং ফেসবুক যাদের নেট মূল্য পর্যায়ক্রমে ১ ট্রিলিয়ন এবং ৭৬৮.১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে দিক থেকে অ্যামাজন টেক কোম্পানি হিসেবে টাকার অংকে দ্বিতীয় পর্যায় আছে।
অ্যামাজনের ওয়্যারহাউসের মোট আয়তন ১ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট এবং অর্ডারকৃত প্রোডাক্ট আনা নেওয়া করতে একজন কর্মীর প্রতিদিন অ্যাভারেজ ১৭ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। প্রতিদিন ১৬ লাখেরও বেশি প্রোডাক্ট অ্যামাজন তাদের ওয়্যারহউস থেকে শিফট করে থাকে। তাদের নিজস্ব কুরিয়ার সার্ভিস এবং ৪০ টি বোয়িং কার্গো বিমান আছে যা ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট শিফটিং করে।
অ্যামাজনের ইতিহাস
অ্যামাজন আজকে যে পর্যায় এসেছে তা সহজ ছিল না, কারণ তখনো মানুষ ভাবেনি যে তারা অনলাইনে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। কিন্তু জেফ বেজোস ছিলেন খুবি চৌখস মানুষ। তার এই অনলাইন ব্যবসা খুব তাড়াতাড়ি মানুষ আপন করে নেয় এবং গ্যারেজ থেকে অ্যামাজনকে ১.৫ ট্রিলিয়ন ইউএস মার্কিন ডলারের কোম্পানিতে দাঁর করায়। অ্যামাজন শুরুতে পুরনো বই বিক্রি দিয়ে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রোডাক্ট যোগ শুরু করে। এদের মধ্যে মিউজিক, ভিডিও, খেলনা, গৃহস্থালি পণ্য ইত্যাদি। এর সাথে সাথে অ্যামাজন নতুন নতুন স্টার্টআপ কোম্পানি কিনতে থাকে। ইতোমধ্যে তারা ৪০ টির মতো কোম্পানি অধিগ্রহন করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো IMDb, Alexa, Whole Food Market, Junglee, Audible ইত্যাদি। প্রোডাক্ট সার্চ করার জন্য তাদের নিজস্ব সার্চ সিস্টেম আছে যার নাম Aka A9 এবং এটি অনেক সুন্দর ও সাবলীল রেজাল্ট দেখায়।
বর্তমানে অ্যামাজন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ইকমার্স সেবা বাদেও ওয়েব সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, রোবটিক্স, ডিজিটাল স্ট্রিমিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইত্যাদি সেবা দিচ্ছে। এছারাও অ্যামাজনের তৈরি কিন্ডেল এবং ইকো এই দুটি ডিভাইস অনেক পপুলার। এছাড়া Blue Origin নামক তাদের একটি অ্যারোস্পেস কোম্পানি আছে। যারা ইতোমধ্যে কক্ষপথে ১৪ টি সফল অভিযান চালিয়েছে।
অ্যামাজন অন্যান্য কোম্পানির থেকে আলাদা হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ এদের বিজনেস প্লান। অ্যামাজনের মোট বিক্রির ৫০% আসে অ্যাফিলিয়েটে মার্কেটার দের থেকে। তাদের দেওয়া কমিশনের ভিত্তিতে মার্কেটার রা প্রোডাক্ট সেল করে কমিশন পায়। যা তাদের ব্যবসাকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
যদিও এখন পর্যন্ত অ্যামাজনের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়েছে কিন্তু এতে তাদের ব্যবসা ঠিকই হচ্ছে। ভালো কাস্টমার সার্ভিস, সময়মতো প্রোডাক্ট পৌঁছে দেওয়া, ভালো কোয়ালিটির প্রোডাক্ট ইত্যাদি কারনে অ্যামাজন এতো পপুলার। ইতোমধ্যে অ্যামাজন বিশ্বের মোটামুটি অনেক দেশেই তাদের সার্ভিস চালু করছে। ভবিষ্যতে অ্যামাজন আরও বড় ও সমৃদ্ধ কোম্পানি হিসেবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে। আশাকরি এই পোস্ট পরে অ্যামাজন সম্পর্কে সবকিছু জেনে গেছেন। এর পরেও যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে কমেন্ট করুন ধন্যবাদ।