ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে এক নতুন ধারায় প্রবাহিত করেছে। এটি জীবন ধারা যেমন সহজ করেছে তেমনি পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় বেঁধেছে। প্রযুক্তি সময়ের সাথে সাথে তার নিজের রূপ বদলে আরও আপগ্রেড হয়েছে। যার ফলে মহাকাশ গবেষণা যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হওয়া ইন্টারনেট অফ থিংস তথা আইওটি ডিভাইস প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই প্রযুক্তি আমাদের জীবন আরও সহজ ও অটোমেশনের দিকে প্রভাবিত করেছে। আমাদের আজকের লেখায় ইন্টারনেট অব থিংস প্রযুক্তি কি? কীভাবে কাজ করে এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ইন্টারনেট অব থিংস প্রযুক্তি কি?
ইন্টারনেট অব থিংস সাম্প্রতিক সময়ের একটি অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবন। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর থেকেই মানুষ এই ধরনের একটি প্রযুক্তি সুবিধা আবিষ্কার করার দিকে মনোনিবেশ করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে আইওটি প্রযুক্তি বিকশিত হতে শুরু করে।
যাইহোক, ইন্টারনেট অব থিংস হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি যা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের মধ্যে ইন্টারনেট দ্বারা সংযোগ ঘটায়। অর্থাৎ আপনার বাসায় থাকা লাইট, ওয়াশিং মেশিন, ওয়াটার পিউরিফায়ার, তাপনিয়ন্ত্রক, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদি আপনি মোবাইলের দ্বারা কন্ট্রোল করতে পারবেন।
আইওটি এর বর্তমান সময়ের সব থেকে ভালো উদাহরণ হচ্ছে স্মার্ট হোম। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক আধুনিক বাসায় এই প্রযুক্তি ইউজ করা হয়। স্মার্ট হোম ইন্সটল করা বাসায় দেখবেন যে বাসার লক থেকে শুরু করে ভিতরের সব কিছুই মোবাইল অ্যাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। আপনি চাইলে ভয়েস কমান্ড ব্যবহার করেও এই কাজ করতে পারবেন।
অর্থাৎ আপনার বাসায় থাকা ইলেকট্রনিক পণ্য গুলো কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে একে অপরের সাথে ডাটা আদান-প্রদান করে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি নিজেরা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আইওটি এর উদ্ভাবক কে?
আইওটি এর শুরু হয় একটি পরিভাষা হিসেবে। ১৯৯৯ সালে পি অ্যান্ড জি এর একটি প্রোজেক্টে কাজ করার সময় কেভিন অ্যাশটন এই শব্দ ব্যবহার করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অটো-আইটি সেন্টারের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সময়ের সাথে সাথে যখন প্রযুক্তি উন্নতি করতে থাকে তখন মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট কাজে লাগিয়ে জীবন সহজ করার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তিবিদগন নানা গবেষণার মাধ্যমে আইওটি ডিভাইস তৈরি করা শুরু করে। পরবর্তীতে শুধু মাত্র একটি পরিভাষা থেকে আইওটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হয়।
ইন্টারনেট অব থিংস এর কাজ
উদ্ভাবনের পর থেকে বিংশ দশকে এই প্রযুক্তির দ্বিতীয় ধাপ চলছে। অর্থাৎ আইওটি প্রযুক্তি তার উন্নতির দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। শুরু দিকে যেখানে শুধু কিছু স্বল্প পরিমাণে ডিভাইস সংযুক্ত করা সম্ভব হত তা বর্তমানে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান মতে বর্তমানে প্রায় ২ বিলিয়নের থেকেও বেশি ডিভাইসে আইওটি সুবিধা রয়েছে।
শুরুর দিকে অনেক অনুন্নত হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হত। যা প্রায় সময় বিভিন্ন ইরর ও সমস্যার সৃষ্টি করতো। তাছাড়া পুরাতন যন্ত্রাংশের কর্মদক্ষতা ও সফটওয়্যার সাপোর্ট খুব একটা ভালো পর্যায় থাকে না। যে কারণে এই ডিভাইস গুলো দিয়ে আইওটি ডিভাইস ধারণার সঠিক প্রয়োগ ও প্রতিফলন সম্ভব হচ্ছিলো না।
কারণ উক্ত সময়ে ডিভাইস গুলো শুধু ডাটা সংগ্রহ ও প্রেরণ করতে সক্ষম ছিল। যে কারণে অনেক ডিভাইসে এই প্রযুক্তি সংযুক্তা করতে গেলে তা ঝামেলার সৃষ্টি করছিল। তবে দ্বিতীয় ধাপে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স চলে আসার কারণে এখন প্রযুক্তি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে আইওটি ডিভাইস ডাটা সংগ্রহ করার জন্য চিপ ব্যবহার করার পাশাপাশি সেন্সর ব্যবহার করে। অর্থাৎ এখন আইওটি ডিভাইস ডাটা শো করার পাশাপাশি অনেক ডাটার ভবিষ্যৎ বের করতে পারে। সহজ করে বলতে গেলে ধরুন আপনি আপনার গার্ডেন এরিয়ায় ঘাস লাগিয়েছেন। এখন আর্দ্রতা রক্ষা করার জন্য আপনাকে প্রতিদিন সকালে এবং দুপুরে মাটিতে হাত দিয়ে দেখতে হয় সেখানে পানির স্বল্পতা আছে কি নেই।
তবে আপনি একটি আর্দ্রতা মাপার আইওটি ডিভাইস এই গার্ডেন এরিয়ায় ইন্সটল করে যদি তা পানি দেওয়ার পাম্পের সাথে কনফিগার করে দেন। তাহলে যখনই আর্দ্রতা কমে যাবে তখন উক্ত ডিভাইস ডাটা সংগ্রহ করে তা সঠিক জায়গায় প্রেরণ করবে। এতে আপনাকে ম্যানুয়ালি কিছুই করতে হচ্ছে না। মোটকথা আপনার সময় বাঁচানোর জন্য আইওটি ডিভাইস অনেক কার্যকরী।
ব্যবসায় আইওটি কীভাবে সাহায্য করে?
ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি কীভাবে একটি ব্যবসায় সাহায্য করে তা নিচে দেওয়া হলো।
ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট
ধরুন আপনার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আছে। যার মধ্যে একটি দোকান এবং একটি ওয়্যারহাউজ রয়েছে। এখন আপনি একলা মানুষ কিন্তু দুইটা প্রতিষ্ঠান একই সাথে পরিচালনা করতে পারবেন না। হয় এখানে আপনাকে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে অথবা নিজেকে কষ্ট করে সব ম্যানেজ করতে হবে।
তবে আপনি আইওটি ডিভাইসের সাহায্য নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একই সাথে পণ্য আসা যাওয়া দেখতে এবং হিসেব করতে পারবেন। অন্যদিকে এই মাধ্যমে কখন কত পরিমাণ ডেলিভারি আসলো এবং কি পরিমাণ পণ্যের চালান বাইরে গেল সকল ডাটা পেয়ে যাবেন। মত কথা একটি কম্পিউটার সিস্টেম ইউজ করে সহজেই আপনি এই সকল বিষয় ২৪ ঘণ্টা তদারকি করতে পারবেন।
সিকিউরিটি ও পারফর্মেন্স মনিটরিং
ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি ও কর্মীদের পারফর্মেন্স মনিটর করার জন্য আইওটি ডিভাইস অতুলনীয়। আপনার প্রতিষ্ঠানকে যদি আপনি স্মার্ট প্রযুক্তির মধ্যে নিয়ে আসেন তাহলে একটি নির্দিষ্ট কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম মনিটর করতে পারবেন।
প্রতিষ্ঠানে থাকা সকল সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কি কি হচ্ছে সেই বিষয়ে সঠিক ধারণা নিতে পারবেন। এই যেমন আপনার প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা কতক্ষণ ডিউটি করে, কোথায় বেশি সময় ব্যয় করে, কোন অপ্রাসঙ্গিক কাজ করে কিনা ইত্যাদি।
এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সিকিউরিটির বিষয় গুলো আপনি বাসা থেকেই তদারকি করতে পারবেন। এতে সুবিধা হচ্ছে আপনি সরাসরি কোম্পানিতে না গিয়ে নানা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের কন্ট্রোল আপনার হাতেই থাকবে।
ইফিসিয়েন্সি
আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে আপনার যেমন আর্থিক খরচ কমে যাবে তেমনি পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে আমরা তো বিজনেস করি কাস্টমারের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে। আইওটি ডিভাইস ইউজ করে আপনি কাস্টমারের রুচি, চাহিদা সহ অন্যান্য জরুরি বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
Internet of things এর সুবিধা ও অসুবিধা?
নিচে ইন্টারনেট অফ থিংস এর কিছু সুবিধা ও অসুবিধা বর্ণনা করা হলো।
সুবিধা
- ডিভাইস টু ডিভাইস সংযোগ স্থাপন করে।
- মোবাইল ডাটা থেকে শুরু করে সকল ধরনের ইন্টারনেট কানেকশন দ্বারা সংযুক্ত করা যায়।
- কাজের গতি বৃদ্ধি করে।
- জীবন-যাপন সহজ করে
- স্মার্টফোন দিয়ে বাসা, অফিস, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল করা যায়।
- সিকিউরিটি বৃদ্ধি পায়।
- অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
- অটোমেশন সুবিধা পাওয়া যায়।
- ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চালানো যায়।
অসুবিধা
- অনেক ব্যয়বহুল।
- বিদ্যুৎ বিল বেশি আসে।
- নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য ঝামেলার।
- শিশু ও বয়স্কদের জন্য অনুপযুক্ত।
- হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- ডাটা লিক হওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
- আর্থিক লোকসানের সুযোগ বেশি।
- বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়।
- নেটওয়ার্ক ইস্যু হলে ব্যবহার উপযোগী থাকে না।
- সব ডিভাইস আইওটির আওতায় পরে না।
- প্রযুক্তি নির্ভরশীলতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
- বেকারত্ব সৃষ্টি করে।
- স্টান্ডার কোন রুলস নেই।
উপরিউক্ত আলোচনায় কীভাবে আইওটি ডিভাইস আমাদের জীবনধারায় প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আজকের লেখায় ইন্টারনেট অফ থিংস কি, এটি কীভাবে কাজ করে, এর ব্যবহার ও বাস্তব জীবনে এর সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়া হয়েছে।