নেটকথার ফ্রিল্যান্সিং গল্পে আজকে আমরা কথা বলবো প্রফেশনাল ওয়েব ডেভেলোপার এবং Finva Soft এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সোহেল আরমান কে নিয়ে। সোহেল কিভাবে একজন ওয়েব ডেভেলোপার হয়ে উঠলো এবং একটি আইটি কোম্পানী গড়ে তুললো সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো তাঁর থেকেই, তো চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।
সংক্ষেপে আপনার পরিচয়
আমি মোঃ সোহেল আরমান। প্রফেশনাল লাইফে ওয়েব এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি ২০১৪ সাল থেকে। ফ্রীল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরু হয় Elance মার্কেটপ্লেস থেকে। বর্তমানে আমি ফিনভা সফট লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শুরু থেকেই ২ টা প্ল্যান হাতে রেখেছিলাম, প্ল্যান A তে ছিল মার্কেটপ্লেসে কাজ করা, আর প্ল্যান B তে ছিল নিজের ব্র্যান্ড ডেভেলপ করার। প্ল্যান B তে ফোকাস একটু বেশি দিয়ে আল্লাহর রহমতে বর্তমানে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি রান করেছি।
ওয়েব ডেভেলোপমেন্ট সম্পর্কে কিভাবে জানতে পারলেন?
বগুড়া পলিটেকনিকে পড়াশুনা করা অবস্থায়, ২০১৩ সালের শুরুতে শেখ আল জামিল নামের এক ভাইয়ের কাছ কে সর্বপ্রথম ওয়েব ডেভলপমেন্ট সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর থেকে গুগল সহ বিভিন্ন রিসোর্স ঘাটাঘাটি করার পর ওয়েব ডেভেলোপমেন্টকে ক্যরিয়ার হিসাবে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বলা বাহুল্য যে, শেখ আল জামিল ভাই বর্তমানে আমার কোম্পানির CTO (চিফ টেকনোলজি অফিসার) ।
কোথায় থেকে ডেভেলোপমেন্ট শিখলেন?
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে জানার পর মোটামুটি ৬-৭ মাস প্রথমে এইটা নিয়ে অনেক রিসার্চ করি এবং জামিল ভাইয়ের রেফারেন্সে বগুড়াতে Technology World Information নামের একটা প্রতিষ্ঠানে ৬ মাসের কোর্সে ভর্তি হই। ভর্তির শুরু থেকেই রেগুলার ছিলাম, কোর্স মেন্টর মিশু ভাই অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলেন, অনেক আন্তরিকতার সহিত তিনি আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। কোর্স শেষে আমি HTML, CSS, Bootstrap, JavaScript (Basic), JQuery, PHP, OOP, MySQL এবং WordPress সম্পর্কে মোটামুটি ভালো আইডিয়া পেয়েছি এবং এগুলো ব্যবহার করে কিছু লাইভ প্রজেক্ট করেছি। বলে রাখা ভালো, কোর্সের বাহিরেও আমি আমার নিজের ইচ্ছেতেই অনেক রিসোর্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি এবং শেখার পারপোজে অনেক লাইভ প্রজেক্ট করেছি । বলতে গেলে, এখান থেকে আমি পরিপূর্ণ একটা গাইডলাইন ও রোডম্যাপ পেয়েছি যা পরবর্তী যাত্রার জন্য ছিল প্লাস পয়েন্ট। আসলে একটা কোর্স বা ট্রেনিং সেন্টার শুধুমাত্র সঠিক গাইডলাইন ও রোডম্যাপ দেখিয়ে দিবে, বাকি রাস্তা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে, এই বিষয়টা মাথায় রেখেই আমি আমার গোল সেট করেছিলাম।
এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কলেজ ও ভার্সিটি লাইফে Computer Science Basics, Fundamentals of Embedded Systems, Data Structures and Algorithms, Software Fundamentals, C Programming, C#.Net, Software testing, Software Quality Assurance, Database Management Systems, Web Software Architecture, Artificial Intelligence, MVC, SDLC সহ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কে মোটামুটি থিওরি ও প্রাক্টিক্যালি জ্ঞান অর্জন করেছিলাম।
ব্যর্থ হয়েছেন কখনো?
হ্যাঁ, লাইফে অনেক বার ব্যর্থ হয়েছি। প্রতিবার ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে অনেক কিছু শিখেছি আবার ঘুড়ে দাঁড়িয়েছি।
বর্তমানে কি নিয়ে কাজ করছেন?
বর্তমানে আমাদের কোম্পানি Finva Soft Ltd. থেকে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট ও ইকমার্স সল্যুশন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের রেডি কিছু প্রোডাক্টস আছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, ল্যাব ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, হাসপাতাল বিলিং সিস্টেম, লারাভেল মাল্টিভেন্ডর ইকমার্স সিস্টেম, হাসপাতাল / ক্লিনিক ওয়েবসাইট ও এডুকেশনাল ওয়েবসাইট। এছাড়াও আমরা যে কোন ধরনের কাস্টম ওয়েব ওয়েবসাইট, ওয়েব এপ্লিকেশন বা সফটওয়্যার ডেভেলপ নিয়ে কাজ করছি। বর্তমানে আমাদের কোম্পানির বোর্ড মেম্বার্স ও টিম মেম্বার্সের সংখ্যা ১৩ জন (অফলাইন + রিমোটলি) । আমি ব্যক্তিগত ভাবে বর্তমানে- কোম্পানির সাকসেশন প্ল্যান, বিজনেস মডেল, বিজনেস এনালাইসিস, ইন্ডাস্ট্রি এনালাইসিস, কম্পিটিটর এনালাইসিস, SWOT এনালাইসিস, গোলস এন্ড অবজেক্টিভস সেট, রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট (R&D), মার্কেটিং প্ল্যান, স্ট্রাটেজি ও সফটওয়্যার/এপ্লিকেশন টেস্টিং নিয়ে কাজ করছি।
ওয়েব ডেভেলোপমেন্টের ভবিষ্যত কেমন?
সাধারণত, দুনিয়াতে যতদিন ওয়েবসাইট থাকবে ঠিক ততদিন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর চাহিদাও থাকবে আকাশচুম্বী । যতই দিন যাচ্ছে ততই ওয়েবসাইটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেকোনো মার্কেটপ্লেসে একজন ওয়েব ডেভেলপার তার কাজের ধারা অনুযায়ী প্রুতি ঘন্টায় ১০ ডলার থেকে ১০০ ডলার পর্যন্ত ইনকাম করে থাকেন । বাংলাদেশে এমন অনেক ডেভেলপার রয়েছেন যারা সাধারণত কাজের আইডিয়া দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকেন । ফ্রিল্যান্সিংয়ে সর্বোচ্চ কাজ বা আয়ের দিক থেকে বিবেচনা করে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ওয়েব ডিজাইনের কাজ সব থেকে বেশি ও ডিমান্ডেবল ।
অনলাইনের বাইরে আর কি কি কাজ করছেন?
আমাদের বিজনেস অনলাইন অফলাইন দুইভাবেই পরিচালিত হয়। যেমন কিছু ক্লায়েন্টের সাথে অনলাইনের মাধ্যমে ডিল হয় আবার কিছু ক্লায়েন্টের সাথে ফিজিক্যালি বা অফলাইনে ডিল হয়। তবে বেশির ভাগ ক্লায়েন্টের সাথে আমাদের অনলাইনেই ডিল করে থাকি।
আপনে কি নিজেকে সফল মনে করেন?
বর্তমানে আমার অবস্থান থেকে আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে আমার এফোর্ট অনুযায়ী যথেষ্ট দিয়েছেন। নিজেকে সফল মনে করি কিনা এই প্রশ্নের উত্তর হলো -সফলতার ফার্স্ট স্টেজে আছি বলে আমার মনে হয়। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে এখনো পরিপূর্ণ সফলতা পাইনি। মাঝখানে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি, সব বাঁধা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট গোল অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। এবং যেভাবে বিজনেস প্ল্যান, স্ট্রাটেজি ও গোল সেট করেছি সেভাবে যদি ইমপ্লিমেন্টেশন করতে পারি তাহলে কোন এক সময় সফলতার চূড়ান্ত স্টেজে যেতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
আপনার ভবিষ্যত প্ল্যান কি?
ভবিষ্যতে আমার কোম্পানিকে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই। কোম্পানির ভ্যালু বাড়াতে চাই, বিশ্বের টপ সফটওয়্যার কোম্পানি গুলোর লিস্টে আমার কোম্পানির নাম নিয়ে যেতে চাই, কোম্পানির রেপুটেশন ভালো করতে চাই। আমাদের সার্ভিস, সাপোর্ট, মেইনটেনেন্স ও আপডেট এর কাজ গুলো আরো উন্নত করতে চাই। ভবিষ্যতে ডাটা সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজেন্স নিয়ে কাজ করতে চাই, ইনশাআল্লাহ ।
নতুন ডেভেলোপারদের উদ্দেশ্য আপনার উপদেশ কি?
নতুন ডেভেলপারদের জন্য আমার উপদেশ হলো, সাধারণত আপনি যখন ওয়েব ডিজাইন ডেভেলপমেন্টের কাজ শেখা শুরু করবেন তখন আপনাকে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে আপনি বড় একটি প্রতিযোগিতায় নামতে চলেছেন এবং এই প্রতিযোগিতায় আপনার প্রতিযোগী হবে সারা পৃথিবীর আরো অনেক ডেভেলপার ।
কিছু দিকনির্দেশনা:
১। প্রথমে আপনাকে ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট কি, এই সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে এবং ধারণা রাখতে হবে। অর্থাৎ এক কথায় আপনাকে এই বিষয়টা নিয়ে খুব ভালোভাবে রিসার্চ করতে হবে এবং বুঝতে হবে।
২। মার্কেটপ্লেসগুলোতে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ করে আপনাকে সফল হতে হলে আপনার অনেক বেশি ধৈর্য শক্তি থাকতে হবে এবং রিসার্চ করার মন মানসিকতা থাকতে হবে। অনেকে আছেন যারা আশা নিয়ে এই সেক্টরে আসেন কিন্তু তাদের ধৈর্য্য শক্তি না থাকার কারণে তারা অনলাইনে ক্যারিয়ার গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই অবশ্যই ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। কোন কিছু না বুঝতে পারলে গুগলে সেটা নিয়ে রিসার্চ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। Stack Overflow সহ অন্যান্য কমিউনিটিতে যুক্ত হতে হবে।
৩। ইংলিশে মোটামুটি দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কেননা ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ শেখার সময় বা কোনো প্রবলেম সল্যুশনের জন্য আপনাকে বিভিন্ন ইংলিশ রিসোর্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে। তাছাড়া আপনি যখন বায়ারের সঙ্গে ডিল করবেন বা কমিউনিকেশন করবেন তখন ইংলিশে অন্তত ক্লায়েন্টের সাথে কমিউনিকেশন করার মতো দক্ষতা থাকতে হবে ।
৪. আপনার মাঝে ক্রিয়েটিভিটি থাকতে হবে এবং ক্রিয়েটিভ চিন্তা করার মানসিকতা থাকতে হবে। এর জন্য আপনাকে প্রচুর পরিমাণে চর্চা ও অনুধাবন করতে হবে। প্র্যাক্টিসের সময় যখন লাইভ প্রজেক্ট করবেন, তখন চেষ্টা করবেন ইউনিক কিছু ডিজাইন করার। এতে আপনার নেক্সট লেভেলে যাওয়ার রাস্তা অনেকটাই সহজ হবে। আপনি যদি ফ্রীল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে চান বা মার্কেটপ্লেস ছাড়াও যদি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চান , তারা আপনার কাজের স্যাম্পল বা পোর্টফোলিও দেখতে চাইবে। কাজের স্যাম্পল বা পোর্টফোলিও যদি ইউনিক ও প্রফেশনাল হয় তাহলে আপনাকে অন্যদের চেয়ে অগ্রাধিকার বেশি দিবে।
৫. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাইন্ডসেট করা। আপনাকে এমনভাবে মাইন্ডসেট করতে হবে যে, আপনি প্রতিদিন নিদির্ষ্ট পরিমাণ সময় কাজ শেখার পিছনে দিতে হবে। আপনাকে প্রতিদিনের লক্ষ্যমাত্রা রাখতে হবে আপনি যেন মিনিমাম ৬ থেকে ৭ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে পারেন । পর্যাপ্ত সময় দিয়ে শিখুন, কথায় আছে কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ শেখার জন্য আপনাকে পর্যাপ্ত পরিমানে সময় দিতে হবে। আপনি যদি কাজ শেখার পিছনে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারেন তাহলে আপনি কোনো দিন ও এই সেক্টরে ভালো কিছু করতে পারবেন না বা আপনি সফল হতে পারবেন না। কাজ মোটামুটি শেখার পর প্রথম দিকে হয়তো কাজ পেতে কিছুট বেগ পেতে হতে পারে তখন হতাশ না হয়ে বরং ধৈর্য্য ধরে আপনার স্কিলগুলোকে ঝালাই করে নিতে পারেন ।
সবশেষে যা বলতে চাই সেইটা হলো, আপনাকে লেগে থাকতে হবে, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অধ্যবসায় এবং ধৈর্য্যসহকারে কাজ করে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। যা শিখছেন সেগুলো নিয়মিত প্রাকটিস করতে হবে, লাইভ প্রজেক্ট করতে হবে, নিজেকে সর্বদা আপডেট রাখতে হবে। কাজ শিখে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আপনার কাজের মূল্য বাড়বে, আপনার ভবিষ্যতের জন্য ভালো একটা ভিত্তি তৈরি হবে ।
One of the great. ❤️