মোবাইল হ্যাকিং একটি ভীতিকর বিষয়। যখন কোন মোবাইল হ্যাক হয় তখন অনেক ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাকারের কাছে চলে যায়। যা একাধারে আমাদের গোপনীয়তা নষ্ট করে এবং সমাজের মাঝে নীচু করে। আমাদের আজকের এই লেখা পড়ে আপনি নিজেকে কীভাবে মোবাইল হ্যাকিং থেকে রক্ষা করতে পারবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করবেন।
মোবাইল হ্যাকিং কি?
প্রযুক্তি দুনিয়ায় হ্যাকিং অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন উপায় ও পদ্ধতি ব্যবহার করে অন্য ডিভাইস বা নেটওয়ার্কের দুর্বলতা খুঁজে বের করে অ্যাক্সেস নেওয়া। বিখ্যাত সিকিউরিটি এক্সপার্ট এবং হ্যাকারের ভাষ্যমতে মাইক্রোচিপ আছে এবং ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা যায় এমন সকল কিছুই হ্যাক করা সম্ভব। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে আমাদের হাতের মোবাইল থেকে শুরু করে ল্যাপটপ কম্পিউটার সকল কিছুই হ্যাক হওয়া সম্ভব।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নিউজে দেখা যায় অমুকের কল রেকর্ড ফাঁস হয়েছে বা গোপন ছবি এবং ভিডিও ফাঁস হয়েছে। এই সকল স্পর্শকাতর বিষয় কিন্তু কেউ ইচ্ছে করে ফাঁস করে না। এই ক্ষেত্রে ১০০% নিশ্চিত থাকা যায় কেউ যে ডিভাইসে এই তথ্য ছিল তা হ্যাক করে তথ্য অনলাইনে মুক্ত করে দিয়েছে।
সচরাচর আমাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোন আমাদের সিকিউরিটি দুর্বলতার অনেক বড় একটি বিষয়। হরহামেশাই এই ডিভাইসগুলো হ্যাক হচ্ছে। এতে যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনগণের সামনে আসছে তেমনি অনেক স্পর্শকাতর বিষয় ফাঁস হচ্ছে।
মোটকথা হ্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন মোবাইল ফোনের অ্যাক্সেস নেওয়ার প্রক্রিয়াকে মোবাইল হ্যাকিং বা স্মার্টফোন হ্যাকিং বলে। আমরা যে ধরনের মোবাইল ফোন ইউজ করি তার বেশিরভাগ হয় আউটডেটেড অথবা সিকিউরিটি দুর্বলতা সম্বলিত।
এই কারণে অনেক সহজেই হ্যাকার এই ডিভাইসের অ্যাক্সেস নিয়ে নিতে পারছে। নিচে আপনার হাতের মোবাইল ফোনটি হ্যাক হয়েছে কি না তা বিস্তারিত জানতে পারবেন।
কীভাবে বুঝবেন মোবাইল হ্যাক হয়েছে
মোবাইল ফোন হ্যাক হয়েছে কিনা তা বোঝার অনেক উপায় আছে। নিচে বিস্তারিত ভাবে সেই সকল উপসর্গ বর্ণনা করা হলো।
দ্রুত চার্জ ফুরিয়ে যাওয়া
আপনার ফোন থেকে যখন স্বাভাবিকের থেকে বেশি চার্জ ফুরিয়ে যাবে তখন বুঝে নিবেন কোন সমস্যা আছে। একজন হ্যাকার যখন কোন ফোন হ্যাক করে তখন রিমোটলি অ্যাক্সেস করার জন্য গোপনে ব্যাকগ্রাউন্ডে অ্যাপ চালু রাখে। এর পাশাপাশি সে দূরে বসে আপনার ফোনের অনেক অপশন ব্যবহার করে। এতে অনেক দ্রুত ফোনের চার্জ সেস হয়ে যায়।
ফোন স্লো হয়ে যাওয়া
মোবাইল ফোন হ্যাক হলে স্বভাবত স্লো হয়ে যায়। এর সব থেকে বড় কারণ হ্যাকার আপনার ফোনে কোন অ্যাপ ইন্সটল করে রাখবে। এটি অনেকটা ব্যাকডোর এর মত কাজ করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে হ্যাকার বারবার আপনার ফোনের অ্যাক্সেস নিতে পারবে। এতে র্যাম এবং প্রসেসর এর উপর অনেক চাপ পড়ে। যা ফোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।
ফোন অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া
হ্যাকার ব্যাকগ্রাউন্ডে বিভিন্ন রকমের প্রসেস চালায়। এতে ফোনের পারফর্মেন্স যেমন কমে তেমনি টা অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। যদিও যে কোন ফোন স্বাভাবিকভাবে ইউজ করলেও গরম হয়। তবে আপনি আপনার ইউজের উপর ভিত্তি করে গরমের মাত্রা যাচাই করলে বুঝতে পারবেন এটি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক।
অপরিচিত অ্যাপ ইন্সটল হয়ে থাকা
ফোনে যদি রেগুলার অ্যাপের বাইরে অন্য কোন অ্যাপ ইন্সটল করা দেখেন তাহলে প্রথমে এর সোর্স খুঁজে দেখবেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন আপনি ভুলে উক্ত অ্যাপ ইন্সটল করেছেন নাকি অন্য কোন মাধ্যম থেকে এসেছে। সন্দেহমুলক অ্যাপ ইন্সটল থাকা মানে হচ্ছে আপনি হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন।
ব্রাউজারে অতিরিক্ত ট্যাব তৈরি হওয়া
ফোনের ব্রাউজারে সচরাচর আপনার ভিজিট করা লিংকের বাইরে যদি কোন লিংক দেখেন তাহলে ধরে নিবেন আপনার ফোনের অ্যাক্সেস অন্য কারো কাছে আছে। অর্থাৎ আপনার ফোনের ব্রাউজারে অপরিচিত ট্যাব ওপেন করা থাকলে বুঝতে হবে আপনার ফোন হ্যাকের শিকার হয়েছে।
ইন্টারনেট কানেকশন দিলে অ্যাড শো করা
বিশেষত অদক্ষ স্মার্টফোন ইউজারদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা বেশি ঘটে, তারা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য বিভিন্ন অ্যাপ ইন্সটল করে এবং সেখানে থাকা বিভিন্ন অ্যাডে ক্লিক করে। এগুলো থেকেই ফোনে অ্যাডওয়ার আক্রমণ করে এবং নেট কানেকশন দেওয়ার সাথে সাথে অ্যাড শো করে। শুরুর দিকে অনেক দেরি করে অ্যাড পপআপ হলেও সময়ের সাথে সাথে গতি বৃদ্ধি পায় এবং ফোন ইউজ করা অসম্ভব হয়ে যায়।
অপরিচিত কল আসা
মোবাইল ফোনে অপরিচিত ফোন আসা একটি স্বাভাবিক বিষয়। কারণ অনেক মানুষ অনুমান করে নাম্বার তুলেও কল দিতে পারে। তবে এই সিস্টেম ইউজ করে অনেক হ্যাকার আপনাকে প্রথমে ম্যানুপুলেট করে আপনার ফোন হ্যাক করা সহ ফিনান্সিয়াল মাধ্যমের অ্যাক্সেস নিয়ে নিতে পারে। যেমন আমাদের দেশে অনেক প্রচলিত বিকাশ হ্যাকিং সিস্টেম হচ্ছে কল করে ম্যানুপুলেট করা।
অপ্রাসঙ্গিক এসএমএস আসা
উল্টাপাল্টা লিংক সহ এসএমএস এবং অপ্রাসঙ্গিক বার্তা আসলে বুঝে নিবেন কিছু একটা গোলমাল আছে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাবে হ্যাকার আপনার ফোন ইউজ করে কাউকে উল্টাপাল্টা এসএমএস করেছে। যার রিপ্লাই আপনি দেখতে পাচ্ছেন।
সেটিং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া
মোবাইল হ্যাক হলে অনেক সময় সেটিংস্ উল্টাপাল্টা হয়ে যেতে পারে। এটি সাধারণত হ্যাকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে সবসময় এমন হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
সিকিউরিটি অ্যাপ ডিজেবল হওয়া
যদিও মোবাইলের জন্য তৈরি করা সিকিউরিটি অ্যাপ ততটা কার্যকরী নয়। তবে কিছু কিছু সাধারণ বিষয় হ্যান্ডেল করার জন্য এই অ্যাপ গুলো অতি প্রয়োজনীয়। তো আপনার ফোনে থাকা কোন সিকিউরিটি অ্যাপ যদি ডিজেবল করা থাকে তাহলে বুঝে নিবেন হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন।
কীভাবে এন্ড্রয়েড ফোন হ্যাক করা যায়? এন্ড্রয়েড হ্যাকিং সফটওয়্যার
ইরর মেসেজ শো করা
কোন অ্যাপ ইউজ করার সময় যদি অপ্রয়োজনীয় ইরর মেসেজ শো করে তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে মোবাইল হ্যাক হয়েছে। এর কারণ হ্যাকার ফোন হ্যাক করার পড়ে কিছু পরিবর্তন করে থাকে। যা অনেক অ্যাপ পরিচালনায় বাঁধার সৃষ্টি করে।
বারবার বিভিন্ন অ্যাপ ফোর্সড ক্লোস আসা
মোবাইল ফোন হ্যাক হওয়া ছাড়াও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে কম কনফিগারেশনের ফোনে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে বারবার এই ঝামেলা তৈরি হলে ফোন হ্যাক হয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।
মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা ইনডিকেটর লাইট চালু হওয়া
অনেক ফোনে মাইক্রোফোন বা ক্যামেরা চালু না বন্ধ তা দেখানোর জন্য ইন্ডিকেটর লাইট ব্যবহার করা হয়। যদি আপনার ফোনে এই ফিচার থাকে এবং আপনি মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা ইউজ না করা অবস্থায় তা জ্বলে ওঠে তাহলে বুঝে নিবেন হ্যাকিং এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
অনলাইন অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে না পারা
অনেক সময় ফোন হ্যাক হলে হ্যাকার অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার পথ বন্ধ করে দেয়। এরকম কিছু দেখলে বুঝে নিবেন হ্যাক হয়েছেন।
অ্যাপল আইডি বা গুগল অ্যাকাউন্ট লক হয়ে যাওয়া
সবসময় না হলেও অনেক সময় হ্যাকার আপনার ফোনের লগইন থাকা অ্যাকাউন্ট লক করে দিতে পারে। যদি স্বাভাবিক উপায়ে এই সকল অ্যাকাউন্ট ইউজ করতে না পারেন তাহলে হ্যাক হয়েছেন কিনা যাচাই করে নিবেন।
গ্যালারীতে অপরিচিত ও উদ্ভট ছবি বা ভিডিও খুঁজে পাওয়া
অনেকসময় মোবাইল হ্যাক করার পর হ্যাকার ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও নিতে পারে। আপনার গ্যালারীতে এই ধরনের কোন অ্যাক্টিভিটি দেখলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল হ্যাক থেকে বাঁচার উপায়
নিচে আপনি আপনার মোবাইল হ্যাক হওয়া থেকে কীভাবে রক্ষা করতে পারবেন তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Install From Unknown Source অপশন বন্ধ রাখা
ফোনের সেটিং থেকে এই অপশন বন্ধ করে দিলে অ্যাপ স্টোরের বাইরে থেকে কোন অ্যাপ ইন্সটল করা যাবে না। এমনকি আপনার ফোনের মেমরিতে ডাউনলোড করা অ্যাপ গুলো ইন্সটল হবে না। এতে হ্যাকার চাইলেই বাইরে থেকে কোন অ্যাপ ইন্সটল করে আপনার ফোন হ্যাক করতে পারবে না।
টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেটর চালু রাখা
এই পরিষেবা ইউজ করলে আপনার ফোনের পাসওয়ার্ড হ্যাকারের কাছে থাকলেও সে লক খুলতে পারবে না বা লগইন করতে পারবে না। কারণ এই ফিচার চালু থাকলে লক খোলার সময় বা ফোনে লগইন করার সময় আপনার নাম্বারে থাকা OTP কোড প্রয়োজন হবে।
সব জায়গায় একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করা
সব জায়গায় একই পাসওয়ার্ড ইউজ করলে সহজে মনে থাকলেও এর অনেক বড় ঝুঁকি রয়েছে। যখন হ্যাকার আপনার যে কোন একটি মাধ্যমের অ্যাক্সেস পাবে তখন সে চাইলেই আপনার অন্যান্য সেবা যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারবে। এই কারণে কখনোই একই পাসওয়ার্ড সকল জায়গায় ব্যবহার করবেন না।
প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোর এর বাইরে থেকে অ্যাপ ইন্সটল না করা
অ্যাপ স্টোর ও প্লে স্টোরে যখন অ্যাপ আপলোড করা হয় তখন তা স্ক্যান করে এবং পুরোপুরি সুরক্ষিত কিনা তা যাচাই করা হয়। এতে আপনি নির্দ্বিধায় সেই অ্যাপ গুলো ইউজ করতে পারবেন।
ক্র্যাক অ্যাপ ইউজ না করা
ক্র্যাক অ্যাপ ইউজ করা আর আপনার ফোন হ্যাকারের হাতে তুলে দেওয়া প্রায় একই জিনিস। সবসময় বাইরে থেকে কোন অ্যাপ ইউজ না করার চেষ্টা করবেন।
পাবলিক ওয়াইফাই ইউজ না করা
পাবলিক নেটওয়ার্ক একটি মোবাইলের জন্য সব থেকে বেশি অসুরক্ষিত মাধ্যম। কারণ হ্যাকাররা সবসময় এই ধরনের ওয়াইফাই গুলোতে ওঁত পেতে থাকে।
উদ্ভট লিংকে ক্লিক না করা
অনলাইনে অথবা মেসেজে কোন লিংক যুক্ত এসএমএস আসলে তা ক্লিক করবেন না। এই পদ্ধতিতে হ্যাকার আপনার ফোনের সম্পূর্ণ অ্যাক্সেস নেওয়ার পাশাপাশি আপনার সকল প্রয়োজনীয় অ্যাকাউন্টের অ্যাক্সেস পেয়ে যাবে।
পর্ণ সাইট থেকে দূরে থাকা
মোবাইল হ্যাক হওয়ার যে কয়েকটি মাধ্যম আছে তার মধ্যে পর্ণ সাইট সবার উপরে। হ্যাকার এই ধরনের সাইটে বিভিন্ন ম্যালওয়্যার দিয়ে রাখে যা মোবাইল ও কম্পিউটার উভয় হ্যাক করে।
উপরিউক্ত আলোচনায় মোবাইল হ্যাকিং কি, এর লক্ষণ ও হ্যাকিং থেকে মুক্ত থাকার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি লেখাটি পড়ে আপনি মোবাইল হ্যাকিং সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন। পাশাপাশি নিজেকে এবং আপনার পরিবারকে হ্যাকিং থেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন।