প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে এআই আমাদের জীবনকে সহজ করার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। আজকাল কিবোর্ডের কয়েকটি স্ট্রোকের মাধ্যমে ভিডিও, ছবি ও প্রয়োজন মতো টেক্সট তৈরি করে নেওয়া যাচ্ছে। এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে ওপেনএআই এর ChatGPT 3.5 নামক চ্যাটবট দ্বারা। আমাদের আজকের আর্টিকেল আমরা চ্যাটজিপিটি কি? এটি কিভাবে কাজ করে? এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
চ্যাটজিপিটি কি?
চ্যাটজিপিটি হল একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন চ্যাট বট। যার পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার। এটি ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর ওপেনআই প্রতিষ্ঠান দ্বারা মার্কেটে লঞ্চ করা হয়। সাধারণত লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের উপর ভিত্তি করে এই চ্যাটবট অ্যাপ্লিকেশান তৈরি করা হয়েছে।
শুরুর দিকে GPT-3 ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে GPT-3.5 প্রকাশ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা পাল্টে দেয়। এই সময় মানুষের মাঝে চ্যাটজিপিটি অ্যাপ্লিকেশান পরিচিতি পেতে থাকে। পরবর্তীতে মডেল GPT-3.5 ফ্রি ভার্শন হিসেবে সবার মাঝে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সাথে GPT-4 রিলিজ দেওয়া হয়। জিপিটি ৪ এ আরও আধুনিক এবং উন্নত ফিচার অ্যাড করে তা প্রিমিয়াম করে দেওয়া হয়।
মার্কেটে উন্মুক্ত করার পরেই এই চ্যাটবট ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রধানত এটি হুবহু মানুষের মত করে কনভারসেশন করতে পারে। একে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সুন্দর করে সাজিয়ে উত্তর উপস্থাপন করে। অন্যদিকে আপনি যে ভাবে যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে। যেমন আপনি যদি কোন লিগ্যাল ডকুমেন্ট তৈরি করতে চান তাহলে চ্যাটজিপিটি কে কমান্ড দিলেই সুন্দর করে ডকুমেন্ট তৈরি করে দিবে।
এমন অনেক ধরনের কাজ আছে যেগুলো সময় সাপেক্ষ কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ, সে সকল কাজ সহজেই এই বট দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়। মূলত একটি চ্যাটবটের নিয়ন্ত্রণে যত বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল থাকবে তার কার্যকারিতা ও স্বতন্ত্রতা তত বেশি থাকবে। এই ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত GPT-3.5 এবং GPT-4 সব থেকে এগিয়ে আছে। ইন্টারনেটে বর্তমানে যে সকল এআই টুল পাওয়া যায় তারা সবাই চ্যাটজিপিটি এর উপর নির্ভর করে তৈরি করা।
চ্যাটজিপিটি কীভাবে কাজ করে?
আমরা আগেই বলেছি এটি একটি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের মাধ্যমে প্রশ্ন বুঝে তারপর উত্তর দেয়। মূলত চ্যাটজিপিটিকে প্রথমে বিভিন্ন প্রকারের ভাষার স্টাইল দিয়ে ট্রেইন করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলে রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক বা সংক্ষেপে (RLHF)। এই পদ্ধতিতে এআইকে শেখানো হয় যে দুইজন মানুষ কীভাবে একে অপরের সাথে কথা বলে।
তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন সেন্টেন্স ফর্মুলা, স্ট্রাকচার ও ওয়ার্ড শেখানো হয়। একটি এআইকে যত বেশি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে অনুশীলন করানো হবে তার পারদর্শিতা তত বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী চ্যাটজিপিটির ভাণ্ডারে প্রায় ৪৫ টেরাবাইট এর মত ডাটা আছে।
অর্থাৎ এতে যত বেশি ডাটা স্টোর হচ্ছে তত বেশি এর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তো চ্যাটজিপিটি কাজ করে কনভারসেশনাল মাধ্যম ব্যবহার করে। যখন আপনি চ্যাটবটে কোন কিছু এন্ট্রি করেন তখন তা প্রথমে লেখাটা এনালাইজ করে এবং নির্ধারণ করে এখানে কি বিষয়ে বলা হয়েছে।
তারপর সেই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নিজের ডাটাবেজ চেক করে এবং একটি উত্তর রেডি করে। উত্তর রেডি করার পর তা ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত করে। এখানে চ্যাটজিপিটি ডিপ লার্নিং টেকনিক ইউজ করে মানুষের মত চিন্তা করে।
এটি ওয়ার্ড আর ছোট ছোট বাক্যের ব্যবহার ও গঠন দেখে ইনপুট সম্পর্কে ধারণা নেয়। তারপর ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, ডিপ লার্নিং, মেশিন লার্নিং ও নিউরাল নেটওয়ার্ক পদ্ধতি ইউজ করে ইনপুট প্রসেস করে তা থেকে ইন্সট্রাকশন এবং ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল হিসেবে ডাটা আউটপুট করে।
এই কারণে আমরা যখন এই টুলকে কোন কঠিন প্রশ্ন করি তখন তা এই সকল মাধ্যমে এনালাইজ করে তা থেকে সম্ভাব্য উত্তর তৈরি করে। যে কারণে GPT-3.5 মডেল আগের ভার্শন থেকে পরিষ্কার, মিনিংফুল, কঠিন বিষয়ের উত্তর করতে পারে। মূলত এই এক্সট্রা অর্ডিনারি কর্মক্ষমতার কারণে বিশ্বব্যাপি চ্যাটজিপিটি এত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নিচে ChatGPT এর সকল ধরনের সুবিধা ও অসুবিধা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
চ্যাটজিপিটির সুবিধা
নিচে ChatGPT এর সুবিধা এবং আমাদের জীবনে এর প্রভাব কেমন সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হলো।
ল্যাঙ্গুয়েজ সাপোর্ট
সাম্প্রতিক তথ্য মতে চ্যাটজিপিটি প্রায় ৫০ টার মত ভাষায় পারদর্শী। এদের মধ্যে বিশ্বে প্রচলিত ইংলিশ, স্প্যানিশ, জার্মান, জাপানিজ, চাইনিজ, ফ্রেঞ্চ, অ্যারাবিক, হিন্দি ও বাংলা অন্যতম। ওপেনএআই নিয়মিত তাদের চ্যাটবটে নতুন নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ সাপোর্ট যোগ করছে। যত বেশি ভাষা এই অ্যাপ্লিকেশানে যোগ হবে তত বেশি এর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
কনভারসেশন সুবিধা
চ্যাট করার সবথেকে বড় সুবিধা হচ্ছে এতে মুখোমুখি বসে কথা বলার মতো অনুভূতি হয়। চ্যাটজিপিটি তাদের অ্যাপ্লিকেশানে এই সুবিধা অনেক সুন্দর করে যোগ করেছে। এখানে আপনি চ্যাট করার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। তাছাড়া অবসর সময় কথা বলার জন্য ChatGPT কে বন্ধু হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট
শুরুর দিকে চ্যাটজিপিটি নিয়ে একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল যে এটি সবার জব খেয়ে ফেলবে। বর্তমানে এই বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলেও এর ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। যাইহোক, ChatGPT আমাদের জন্য একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট বাদে আর অন্য কিছু না। কর্মক্ষেত্রে বা পার্সোনাল সমস্যা সমাধানের জন্য এটি আমাদের সাহায্য করতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ সমাধান দিতে পারে না। যেমন ধরুন চ্যাটজিপিটিকে আপনি একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে দিতে বললেন। সে প্রায় সব ধরনের কোড লিখতে পারলেও কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারবে না। তবে আপনার কোডের কোন কোন অংশ লিখে দিয়ে আপনার কাজ দ্রুত করতে সাহায্য করবে।
কঠিন সমস্যার সমাধান
ChatGPT এর অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে এটি কঠিন সমস্যার সমাধান করার সাজেশন দিতে পারে। অর্থাৎ জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা সহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে কঠিন সমস্যার সমাধান দিতে পারে। এটি যেমন অনেক দ্রুত উত্তর করতে পারে তেমনি উচ্চমানের টেক্সট, ডায়াগ্রাম, ইনফোগ্রাফিক ইত্যাদি আউটপুট দিতে পারে।
সব ধরনের কনটেন্ট লিখতে পারে
ধরুন আপনি একটি প্রোপার্টি কিনতে আগ্রহী যার জন্য আপনার লিগ্যাল ডকুমেন্ট লাগবে। আপনি ঘরে বসে নিজের মোবাইল অথবা কম্পিউটার দিয়ে চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে সহজেই এই ডকুমেন্ট তৈরি করে নিতে পারবেন। লিগ্যাল ডকুমেন্ট বাদেও নিত্যদিনে চলার পথে যে ধরনের ডকুমেন্ট যেমন রেজিগনেশন লেটার, প্রশংসা পত্র, নোটিশ ইত্যাদি সহ ব্লগিং করার জন্য এই অ্যাপ্লিকেশান ব্যবহার করা যায়।
চ্যাটজিপিটির অসুবিধা
নিচে ChatGPT এর অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ভুল তথ্য দেয়
চ্যাটজিপিটি কি তা আমরা সবাই জানি যাতে জেনারেট হওয়া সকল প্রকারের তথ্য যে ১০০% সঠিক এমন নয়। যেহেতু এটি একটি কন্ট্রোলড ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সেহেতু এটি সবসময় সঠিক তথ্য দিতে পারে না। অন্যদিকে এটি ওয়ার্ড এবং বাক্য এর মধ্যকার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে নতুন বাক্য তৈরি করে। যে কারণে অনেকসময় অনেক উদ্ভট উত্তর তৈরি হয়। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষক তাদের রিপোর্টে বলেছে এই অ্যাপ্লিকেশান ভ্রান্ত উত্তর তৈরি করে যা ইনপুট দেওয়া বিষয়ের সাথে কোনোভাবেই মেলে না। কারণ এটি ইন্টারনেট থেকে যে ডাটা পায় তা শো করে দেয়। আর ইন্টারনেটে থাকা সকল ডাটা কিন্তু সঠিক নয়।
বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা কম
এই চ্যাটবটের বাস্তব জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। যে কারণে বাস্তব জীবনের উপর ভিত্তি করে উত্তর জেনারেট করতে পারে না। তাছাড়া এটি উত্তর করার সময় নির্দিষ্টভাবে চিন্তা করে যে কারণে আশানুরূপ ফল পেতে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখতে হয়।
ক্রিয়েটিভিটি নাই
হিউম্যান আর মেশিনের মধ্যে সব থেকে বড় পার্থক্য হচ্ছে ক্রিয়েটিভিটিতে। চ্যাটজিপিটির নিজস্ব কোন সৃজনশীলতা নেই। এটি মানুষের মতো করে চিন্তা করতে পারে না।
সীমিত জ্ঞান
মানুষের সাথে তুলনা করলে এই অ্যাপ্লিকেশানের জ্ঞানের পরিধি খুব সীমিত। কারণ মানুষের মাথায় কমপক্ষে ২.৫ মিলিয়ন গিগাবাইট ডাটা স্টোরেজ ক্যাপাসিটি থাকে। সেই দিক থেকে তুলনা করলে ChatGPT এর জ্ঞান খুবই সীমিত। অন্যদিকে এই অ্যাপ্লিকেশান ইন্টারনেটে উপস্থিত ২০২১ সালের আগের ডাটা দেখাতে পারে। এর বাইরে আর কোনো ডাটা দেখাতে পারে না।
প্রসঙ্গ বুঝতে পারে না
সৃজনশীলতা না থাকার কারণে এটি কোন প্রকারের প্রসঙ্গ বুঝতে পারে না। আপনাকে কমান্ড দেওয়ার সময় ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে যে একে কীভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারপরেও এটি উদ্ভট ধরনের উত্তর জেনারেট করবে।
ইমোশন বুঝতে পারে না
চ্যাটজিপিটি ইমোশন বুজতে পারে না। এর উত্তর সব সময় একই ধারার হয় যা সহজেই বোঝা যায়। অন্যদিকে, স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে এটি সহায়তা করতে পারে না। এই কারণে মানুষের মতো করে চিন্তা করতে পারে না।
ট্রান্সলেট করতে পারে না
যদিও এখন পর্যন্ত এই অ্যাপ্লিকেশান সঠিকভাবে ট্রান্সলেট করতে পারে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে যখন এর ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি হবে তখন ধীরে ধীরে এই সুবিধা মূল প্রোগ্রামে যোগ হবে।
চ্যাটজিপিটি আমাদের জীবন অনেক সহজ করে তুলেছে। আমাদের নিত্য জীবনের অনেক কাজ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে দ্রুত হয়েছে। আমাদের আজকের লেখায় চ্যাটজিপিটি কি এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।