ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার পর কম্পিউটার দুনিয়ায় একটি বিপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এতে এক দিকে যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় তেমনি ঝুঁকির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। মানব শরীরে অসুখ ধরানোর জন্য যেমন বিভিন্ন ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থাকে তেমনি কম্পিউটার কর্তৃক পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতি করার জন্য কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি হয়েছে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ১০টি কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সবচেয়ে মারাত্মক ১০টি কম্পিউটার ভাইরাস
আমাদের আজকের লেখায় প্রযুক্তি জগতে সব থেকে বেশি ক্ষতি করা ১০টি কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
Cryptolocker
ক্রিপ্টোলকার একটি প্রসিদ্ধ ম্যালওয়্যার যা ট্রোজান ভাইরাস গোত্রের অন্তর্গত। ২০১৩ সালের দিকে এটি পুরো বিশ্বে সর্বপ্রথম পরিচিতি পায়। এটি সিস্টেমে প্রবেশ করার সাথে সাথে ইন্টারনাল ডিভাইস সহ এক্সটারনাল ডিভাইসগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে এটি সিস্টেমে থাকা সকল ফাইল খুঁজে বের করে এবং তা লিস্ট করে। লিস্ট শেষ হওয়ার পর এই ম্যালওয়্যার একটি বিশেষ এনক্রিপশন অ্যালগরিদম ইউজ করে সকল ফাইল এনক্রিপ্ট করে ফেলে।
অর্থাৎ ক্রিপ্টোলকার যখন আপনার সিস্টেমে প্রবেশ করবে তখন এটি আপনার সকল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ থেকে ফাইল খুঁজে বের করে এনক্রিপ্ট করে ফেলে। এই ফাইল গুলো একটি নির্দিষ্ট ডিক্রিপ্ট কোড ছাড়া কখনোই খোলা সম্ভব নয়। যে কারণে অ্যাটাকের পর আপনি যতই চেষ্টা করেন ফাইল অ্যাক্সেস করতে পারবেন না।
আপনি বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সেই ফাইল গুলো এডিট বা ফাইলগুলোর এক্সটেনশন পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন। তবে এতে আপনি আপনার মূল ফাইল চিরতরে হারাবেন এবং কোন ভাবেই তা আর রিকভার করা সম্ভব নয়।
তবে ক্রিপ্টোলকার অ্যাটাকের পর ফাইল গুলো পুনরুদ্ধার করার জন্য আপনার কাছে অর্থ দাবি করা হবে। এই অর্থ পরিশোধ করলে অনেক সময় ফাইল পুনরুদ্ধার হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে হ্যাকারের উপর। তো ২০১৩ সালের পর থেকে এই ভাইরাস বিভিন্ন মাধ্যম যেমন ই-মেইল, ফেক সফটওয়্যার আপডেট এবং ইনফেক্টেড ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
NotPetya
নটপেটিয়া হচ্ছে পেটিয়া র্যাঞ্জমওয়্যার গোত্রের একটি ভার্সন। এই ভাইরাস দিয়ে ২০১৭ সালে পুরো ইউক্রেন জুড়ে একটি ভয়ংকর সাইবার অ্যাটাক পরিচালনা করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী সেই সময় পুরো দেশব্যাপী সকল সরকারি ও আর্থিক সাইটের উপর হামলা পরিচালনা করা হয়। যা থেকে ধারণা করা হয় ৩০০ মিলিয়নের উপর লস হয়।
সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে এই ভেরিয়েন্ট রাশিয়া দ্বারা তৈরি। অনেকে মনে করে তাদের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনে এই হামলা পরিচালনা করা হয়। ঘটনা যাই হক, এই ভাইরাস অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
অন্যান্য র্যাঞ্জমওয়্যার থেকে নটপেটিয়া কার্যক্রমের দিক থেকে ভিন্ন। গতানুগতিক র্যাঞ্জমওয়্যার যেখানে ফাইল এনক্রিপ্ট করে টাকার বিনিময়ে ডিক্রিপ্ট করে দেয় সেখানে এটি ফাইল এনক্রিপ্ট করে ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ অন্যান্য র্যাঞ্জমওয়্যার ভাইরাস অ্যাটাক করলে হ্যাকার টাকার বিনিময়ে ফাইল ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু নটপেটিয়া তৈরি করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সিস্টেমে প্রবেশ করে যত বেশি ফাইল নষ্ট করা যায় তত ভালো।
এটি মূলত ভিক্টিমের সকল ফাইল নষ্ট করে ক্ষতির মুখে ফেলার উদ্দেশ্যে তৈরি। এই ভাইরাস অ্যাটাকের প্রধান প্রধান টার্গেট হচ্ছে, পাওয়ার গ্রিড, ব্যাংক, শেয়ার বাজার, ফিনান্সিয়াল সংস্থা, সরকারি ওয়েবসাইট ইত্যাদি।
Code Red
২০০১ সালের দিকে গোটা ইন্টারনেট দুনিয়ায় একটি স্মরণকালের সেরা ধ্বংসাত্মক সাইবার হামলা পরিচালিত হয়। ধারণা করা হয় এই হামলার কারণে সেই সময় মোট ২.৪ বিলিয়নের মত অর্থ ক্ষতি হয়। পাশাপাশি প্রায় ১ মিলিয়নের মত কম্পিউটার সিস্টেম আক্রান্ত হয়।
কোড রেড ভাইরাস তৈরি করা হয়েছিল মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ সার্ভারের দুর্বলতাকে টার্গেট করে। পুরো ইন্টারনেট দুনিয়ায় আতঙ্ক ছড়ানো এই ভাইরাস যখন একটি সিস্টেমে প্রবেশ করে তখন তা ব্যাকটেরিয়ার মত বংশ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ এটি সিস্টেমে প্রবেশ করার পর নিজেকে রেপ্লিকেট করে এবং উক্ত সার্ভারের সাথে সংযুক্ত অন্যান্য সার্ভারে এবং ডিভাইসে সিরিজ অ্যাটাক পরিচালনা করে।
এতে এই ভাইরাস একটি দুর্বল সার্ভারের মাধ্যমে হাজার হাজার সার্ভারের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পারে। তবে সব থেকে বড় আতঙ্ক এবং ঝামেলা শুরু হয় তখন যখন হ্যাক হওয়া ডিভাইসে “Hacked by Chinese” লেখা প্রদর্শিত হয়।
এতে সাইবার ওয়্যার এর পাশাপাশি কোল্ড ওয়্যার বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চায়নার সম্মানহানি হয়। অন্যদিকে এই ভাইরাস সহজেই সকল এন্টিভাইরাস সফটওয়্যারকে বাইপাস করতে পারে। যে কারণে এটি খুঁজে বের করা এবং ডিলিট করা অনেক কঠিন হয়ে পরে। তবে এই বিষয়ে মাইক্রোসফট অনেক দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং তাদের আইআইএস সার্ভারের জন্য সিকিউরিটি প্যাঁচ রিলিজ করে। যা ভাইরাস রিমুভ করার পাশাপাশি সার্ভার সিস্টেম সুরক্ষিত করে।
WannaCry
ওয়ানাক্রাই যা বাংলা করলে দাঁড়ায় “কাঁদতে চাই” একটি র্যাঞ্জমওয়্যার ভাইরাস। এটি ২০১৭ সালে ১৫০ টি দেশের ২ লাখের উপরে কম্পিউটার সাইবার অ্যাটাক পরিচালনা করে। গতানুগতিক র্যাঞ্জমওয়্যারের মত এর উদ্দেশ্য ছিল ভিক্টিমের কম্পিউটারে থাকা পার্সোনাল ফাইল এনক্রিপ্ট করে তার পরিবর্তে অর্থ দাবি করা।
তৎকালীন সময় মাইক্রোসফট উইন্ডোজের একটি সিকিউরিটি দুর্বলতার মাধ্যমে এটি ইন্টারনেট থেকে সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করে। তারপর স্টোরেজ ডিভাইসে থাকা সকল ফাইল লক করে এক্সটেনশন পরিবর্তন করে ফেলে। তখন সেই ফাইল গুলো পুনরুদ্ধার করার জন্য ভিক্টিমের কাছে ৩০০ ডলার চাওয়া হয়। যদিও এই টাকার পরিবর্তে ফাইল আনলক করার পাসওয়ার্ড দেওয়ার কথা থাকে তবে এই বিষয়ে কোন প্রকারের নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্বব্যাপি আতঙ্ক ছড়ানো এই ভাইরাস অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে একজন ২২ বছর বয়সি সিকিউরিটি রিসার্চার এই ভাইরাসের প্রস্তুতকারককে খুঁজে বের করে এবং এর বিস্তার প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়।
Zeus
জিউস বা জেডবট ভাইরাস প্রধানত একটি ব্যাংকিং ট্রোজানহর্স ভাইরাস। এর সব থেকে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে সিস্টেমে প্রবেশের পর এটি হ্যাকারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এতে হ্যাকার যেমন সিস্টেমের রিমোট অ্যাক্সেস পায় তেমনি গোপনে আরও ম্যালওয়্যার ইন্সটল করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
২০০৭ সালে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সেরা ৫০০ টি কোম্পানির ৮০% এর সিস্টেমে প্রবেশ করে এবং ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। এটি তৎকালীন সময় থেকে বর্তমান সময়ে ব্যাংকে যত ধরনের ম্যালওয়্যার অ্যাটাক হয় তার ৪৪% হয় জিউস এর মাধ্যমে। রিপোর্ট অনুযায়ী এই ভাইরাস এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ বিলিয়ন আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে।
এটি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েবসাইট ও ইমেইলের মাধ্যমে ছড়ায়। জিউস ভাইরাসের সব থেকে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে এটি এন্টিভাইরাস বাইপাস করতে পারে এবং নিজে নতুন ভার্সনে আপডেট হতে পারে।
Klez
ক্লেজ ভাইরাস ২০০১ সালে রিলিজ হয় যা ইমেইলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরে। রিপোর্ট অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে এই ভাইরাস সাত মিলিয়ন কম্পিউটারে হামলা চালায় এবং ২০ মিলিয়ন আর্থিক ক্ষতি সাধন করে।
সাধারণত এটি ই-মেইল এর অ্যাটাচমেন্টের মাধ্যমে ছড়ায়। যখন কোন রিসিভার এই অ্যাটাচমেন্টে ক্লিক করে তখন তা উক্ত কম্পিউটারে ছড়িয়ে পরে এবং তার অ্যাড্রেস বুকে থাকা ইমেইলে একই ভাবে অ্যাটাক করে।
সময়ের সাথে সাথে এর আরও কিছু ভার্সন রিলিজ করা হয় যা এন্টিভাইরাস বাইপাস সহ আরও বেশি ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড করতে পারদর্শী।
ILOVEYOU
এই কম্পিউটার ভাইরাসকে অনেকে লাভলেটার ভাইরাস হিসেবে চিনে থাকে। ফিলিপাইনের একটি স্টুডেন্ট অন্যের কম্পিউটার থেকে পাসওয়ার্ড চুরি করার জন্য এই ভাইরাস তৈরি করে। তার উদ্দেশ্য ছিল সে যে ধরনের সার্ভিস কিনে ব্যবহার করতে পারবে না সেগুলোর অ্যাক্সেস অন্যের কাছ থেকে নেওয়া।
তবে ভাইরাসটি তৈরি হওয়ার পর ১ ঘণ্টায় পুরো পৃথিবীর ১০ মিলিয়ন পিসিতে ছড়িয়ে পরে। অন্যান্য ভাইরাস যেখানে প্রোগ্রাম হিসেবে ইন্সটল হতে হয় সেখানে এটি একটি টেক্সট ফাইলের মাধ্যমে কাজ করে। সাধারণ উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই ভাইরাস ২০০০ সালের দিকে প্রযুক্তি দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ১৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধন করে।
Mydoom
২০০৪ সালে আবিষ্কৃত হওয়া মাইডুম ভাইরাস যা W32.Mydoom@mm নামে পরিচিত বিশ্বব্যাপি দ্রুত ছড়িয়ে পরে। এর বিস্তার এত দ্রুত হচ্ছিলো যে দিনে প্রায় ১ মিলিয়ন কম্পিউটার সিস্টেম আক্রান্ত হয়েছিল।
এটি সাধারণত ফাইল শেয়ারিং ওয়েবসাইট ও ইমেইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। সিস্টেমে প্রবেশের পর এই ভাইরাস হ্যাকারের রিমোট অ্যাক্সেসের জন্য ব্যাকডোর ওপেন করে রাখে। যা আরও বেশি ক্ষতি করে। রিপোর্ট অনুযায়ী এই ভাইরাস প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করে এবং অনেক কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ই-মেইল সার্ভিস সাময়িক বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
Conficker
২০০৮ সালে রিলিজ হওয়া কনফ্লিকার ভাইরাস যা Downadup নামে পরিচিত শুধু মাত্র উইন্ডোজ কম্পিউটারকে টার্গেট করে। এটি পিয়ার টু পিয়ার কানেকশন ব্যবহার করে যা একে খুঁজে পেতে ও ডিলেট করতে অনেক কষ্টকর করে তোলে।
এটি সিস্টেমে প্রবেশের পর ভিক্টিমের কম্পিউটারে থাকা বিভিন্ন সাইটের ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড চুরি করার পাশাপাশি আরও অনেক বড় ধরনের ক্ষতি করে। সামর্থ্যের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটি অনেক ক্ষতিকারক এবং বর্তমানেও এর ব্যবহার প্রচলিত আছে।
কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত কি না জানার ১০ কৌশল
SoBig
২০০৩ সালে রিলিজ হওয়া এই ভাইরাস সিস্টেমের সিকিউরিটি দুর্বলতা খুঁজে বের করে কম্পিউটারে প্রবেশ করে। তারপর নিজের কপি তৈরি করে ভিকটিমের কম্পিউটারে থাকা সকল ই-মেইল কন্টাক্টে ম্যালওয়্যার যুক্ত মেইল পাঠায়।
এভাবে উক্ত সময়ে সোবিগ ভাইরাস অগণিত সিস্টেমে হামলা করে এবং ৩০ বিলিয়নের মত আর্থিক ক্ষতি করে। এটি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের বড় বড় দেশে ছড়িয়ে পরে এবং নিজের আরও কয়েকটি উন্নত ভার্সন তৈরি করে।
উপরিউক্ত আলোচনায় কম্পিউটার ভাইরাস কীভাবে আমাদের ক্ষতি করে ও বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ১০টি কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনি কম্পিউটার ভাইরাস কীভাবে কাজ করে এবং সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করেছেন।