চোখ আমাদের দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটি আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে ও অনুভব করতে সাহায্য করে। তবে নানা ধরনের অনিয়ম তথা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার অথবা মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে তা আমাদের চোখের অনেক ক্ষতি করে। মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে চোখে কম দেখা অথবা ঝাপসা দেখার মত সমস্যার সৃষ্টি করে। আমাদের আজকের লেখায় কম্পিউটার ব্যবহারে ভালো চশমা কোনটি এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
কম্পিউটার ব্যবহারে ভালো চশমা কোনটি এবং কেন প্রয়োজন?
আমাদের চোখ অনেক সেনসিটিভ একটা অঙ্গ। শরীর পরিচালনার জন্য এর ব্যবহার অপরিহার্য। তবে আমাদের গাফিলতি ও অনিয়মের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অনেক ক্ষতিসাধন হয়। অতিরিক্ত রোদে ঘুরলে বা সবসময় ধুলোবালির মধ্যে থাকলে চোখের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি ভিটামিনের অভাবে দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে।
তবে বর্তমান যুগে আমাদের অতিরিক্ত ডিজিটাল স্ক্রিন আসক্তি চোখের ক্ষতির জন্য সব থেকে বেশি দায়ী। সাধারণত কম্পিউটার এবং মোবাইল স্ক্রিন থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক রশ্মি যেমন UV, ভায়োলেট, নীল লাইট ইত্যাদি বের হয়। এগুলো চোখের জন্য অনেক ক্ষতিকারক। তাছাড়া যখন একটি ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা হয় তখন তা চোখের চারপাশের পেশীতে প্রেসার তৈরি করে। পরবর্তীতে এই প্রেসারের কারণে চোখ ব্যথা, অস্বস্তি, মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তো সব থেকে কম খরচে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য চশমা ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞ চক্ষু ডাক্তারদের মতে ডিজিটাল স্ক্রিন যেমন মোবাইল এবং কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় অবশ্যই চশমা পড়ে নিতে হবে। কারণ চশমায় থাকা গ্লাস ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে আশা অতিরিক্ত আলো এবং ক্ষতিকারক রশ্মি ব্লক করে দেয়। এতে চোখের উপর তেমন চাপ পড়ে না। এই কারণে চোখের যেমন ক্ষতি রোধ হয় তেমনি মাথা ব্যথা সহ অন্যান্য শারীরিক ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
ব্লু কাট গ্লাস কি?
ব্লু কাট গ্লাসের কাজ হচ্ছে যে কোনো ধরনের নীল আলো ফিলটার করে ক্ষতিকারক অংশ বাদ দিয়ে উপকারী অংশ প্রোভাইড করা। অর্থাৎ আপনি যখন কোন ডিজিটাল স্ক্রিন এই গ্লাস দিয়ে দেখবেন তখন তা নীল আলো কে দুইভাগে ভাগ করবে। প্রথমত ক্ষতিকারক আলো বাদ দিবে এবং উপকারী অংশকে ফিলটার করে বাদ দিবে।
প্রয়োজন ভেদে এবং কি পরিমাণ নীল আলো বাদ দিবেন তা গ্লাসের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ এই গ্লাস তৈরি করার সময় কোম্পানি ভেদে ফিল্টারিং মাত্রা ১০% থেকে ৯০% পর্যন্ত হতে পারে। কার্যকারিতার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত দিয়ে থাকে।
অনেক গবেষণায় দেখা যায় যে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নীল আলো ফিলটার করার জন্য ব্লু কাট গ্লাস তেমন কার্যকরী নয়। তবে ইউজার রিভিউ থেকে ধারণা পাওয়া যায় এটি অনেকের ক্ষেত্রে কাজ করে আবার অনেকের ক্ষেত্রে করে না।
অন্যদিকে এই গ্লাস চোখের উপর পরা চাপ কমাতে সাহায্য করে যা মাথা ব্যথা প্রতিরোধ করে। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে ক্লান্তিভাব দূর করে। তাছাড়া এই গ্লাস ব্যবহার করলে অনেক ভালো ঘুম হচ্ছে।
কম্পিউটার গ্লাস কি?
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রকমের গ্লাস পাওয়া যায়। প্রধানত বিভিন্ন রকম প্রয়োজনের খাতিরে বিশেষভাবে এই ধরনের আলাদা আলাদা নামের চশমা তৈরি করা হয়। তবে এদের মধ্যে সব থেকে বেশি ব্যবহার হওয়া গ্লাস হচ্ছে রিডিং চশমা। আমরা যদি রোদ চশমা আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দেই তাহলে রিডিং চশমা সবার থেকে উপরে থাকবে।
কারণ আমরা যখন বই পড়ি তখন দীর্ঘক্ষণ ছোট ছোট লেখার দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। যা আমাদের চোখের বিভিন্ন পেশির উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। এতে দৃষ্টিশক্তি কমে আসার পাশাপাশি নানা শারীরিক সমস্যার দেখা দেয়। এই কারণে রিডিং চশমা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করে সহজেই লেখা পড়া সম্ভব হয়।
অন্যদিকে কম্পিউটার ব্যবহার করার জন্য আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে আমাদের চোখের দূরত্ব কমপক্ষে ২০-২৪ ইঞ্চি হওয়া প্রয়োজন। এতে সাভাবিকভাবেই চোখের উপর যেমন চাপ কম পরবে তেমনি বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মি তেমন ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।
যাইহোক, কম্পিউটার গ্লাস আর রিডিং গ্লাস প্রায় একই জিনিস। কারণ অনেক গবেষকদের মতে রিডিং গ্লাসের যে ফিচার থাকে তার সব কিছুই একটি কম্পিউটার গ্লাসের সাথে মিলে যায়। যদিও বর্তমান সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কম্পিউটারের জন্য আলাদা আলাদা ফিচার সম্বলিত গ্লাস তৈরি করছে। কারণ ডিজিটাল স্ক্রিনের নানান পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হলে গ্লাস ডিজাইন তথা এর স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করতে হবে।
না হলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা গ্লাস ব্যবহার করবো তা পুরন হবে না। মোটকথা কম্পিউটার ব্যবহার করার জন্য আপনি রিডিং গ্লাস ব্যবহার করার পাশাপাশি কম্পিউটারের জন্য বিশেষ গ্লাস যেমন ব্লু কাট, UV কোটেড ইত্যাদি গ্লাস ব্যবহার করা যাবে।
কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করার সুবিধা
নিচে কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করার সুবিধাগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
চোখের উপর চাপ কমায়
আমরা জানি চোখের নিজস্ব কোন আলো নেই। অর্থাৎ কোন অবজেক্টের উপর আলো পড়ে যখন তা আমাদের চোখে প্রবেশ করে তখন আমরা উক্ত জিনিস দেখতে পাই। তো যখন আমরা কম্পিউটার এর সামনে বসে থাকি তখন উক্ত ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে আমাদের চোখে সার্বক্ষণিক আলো আসতে থাকে। এতে চোখ এবং এর আশেপাশের পেশি গুলোর উপরে অনেক চাপ পড়ে। যা থেকে পরবর্তীতে মাথা ব্যথা, চোখের ক্লান্তি সহ নানা সমস্যা তৈরি হয়।
কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করা হলে স্ক্রিন থেকে বিকিরিত আলো পরিমিত মাত্রায় চোখে পৌঁছায়। এতে সকল ক্ষতিকারক রশ্মি ফিলটার হওয়ার কারণে চোখের এবং এর কাছের পেশিগুলোর উপর তেমন চাপ পড়ে না। এতে চোখ সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকে।
পরিমিত ঘুমোতে সাহায্য করে
ঘুম মানব শরীরের একটি অপরিহার্য বিষয়। পরিমিত ঘুম না হলে তা আমাদের মানুষিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। কিন্তু নিয়মিত ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহার করার কারণে তা আমাদের স্বাভাবিক ঘুমের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতিসাধন করে।
তাছাড়া নিয়মিত কম্পিউটার ও মোবাইল ইউজ করার কারণে তা আমাদের মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব ফেলে যা অনিদ্রার সৃষ্টি করে। কিন্তু এই সকল ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার সময় যদি কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করা হয় তাহলে চোখের সম্ভাব্য ক্ষতি এড়ানো যায়। কারণ চশমা ব্যবহারে চোখের দেখার উপর কোনো চাপ পড়ে না। যা এই অঙ্গের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখে।
আরাম বৃদ্ধি করে
কম্পিউটার চশমা আমাদের চোখের জন্য পরিমিত আলো সরবরাহ করে। অতিরিক্ত রোদের আলো সহ আরও যত ক্ষতিকারক রশ্মি আছে তা ব্লক করে। এতে চোখের দেখার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় না। যা মস্তিষ্ক ও চোখের সাথে সম্পর্কিত অঙ্গের আরাম বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করে আপনি সুরক্ষার পাশাপাশি আরামের সাথে দুনিয়া দেখতে ও উপভোগ করতে পারবেন।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে
দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া অথবা একে বারে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে যে যে কারণ আছে তার মধ্যে ক্ষতিকারক রশ্মি ও অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি অন্যতম। বিশেষ করে যদি আপনি একটা লম্বা সময় কোন নির্দিষ্ট জিনিসের উপর যেমন বই, মোবাইল অথবা কম্পিউটারের দিকে চেয়ে থাকেন তাহলে তা আপনার দৃষ্টিশক্তি কমানো শুরু করবে।
কিন্তু নিয়মিত কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করার কারণে আপনার দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি অনেক অংশে কমিয়ে আনা যাবে। কারণ এই সকল গ্লাস বিশেষভাবে তৈরি করা হয় যা চোখের জন্য ক্ষতিকারক সকল রশ্মি আটক করে এবং এর অতিরিক্ত কার্যক্রম হ্রাস করে।
প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি করে
ধরুন আপনি একটি অফিসে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করছেন। কিন্তু আপনার একটু পর পর খুব ঘুম পাচ্ছে। এতে আপনি উক্ত কাজে যেমন মনোযোগ দিতে পারছেন না তেমনি আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকছে। এতে আপনার প্রোডাক্টিভিটি কিন্তু একে বারেই কমে যাচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি কম্পিউটার গ্লাস ব্যবহার করে উক্ত ডিভাইস ইউজ করেন তাহলে আপনার যেমন ঘুম পাবে না তেমনি ক্লান্তি কমে যাবে। এতে সর্বোপরি আপনার প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি পাবে।
সঠিক কম্পিউটার গ্লাস নির্বাচন করার উপায়
বাজারে বিভিন্ন নাম এবং ফিচার সম্বলিত কম্পিউটার গ্লাস পাওয়া যায়। এর সবগুলো যে সবার জন্য প্রযোজ্য তা নয়। তবে আপনার নিজের জন্য যখন গ্লাস নির্বাচন করতে যাবেন তখন কি কি বিষয়ের উপর নির্ভর করবেন তা নিচে দেওয়া হলো।
প্রেসক্রিপশন
যে কোন সাধারণ অথবা কম্পিউটার গ্লাস নির্বাচন করার আগে আপনাকে একজন স্পেশালিস্ট এর সাথে দেখা করে নিতে হবে। সেখানে আপনার চোখের বর্তমান অবস্থা এবং অন্য কোনো সমস্যা আছে নাকি নেই সে সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যখন আপনি ডাক্তারকে কম্পিউটার ব্যবহার করার কথা বলবেন তখন সে আপনাকে কোন ধরনের চশমা ব্যবহার করা উচিত সে বিষয়ে প্রেসক্রিপশন তৈরি করে দিবে।
লেন্স এর কোয়ালিটি
লেন্স নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সবার প্রথমে দেখবেন এন্টি রিফ্লেকশন ও ব্লু লাইট ফিলটার ফিচার আছে নাকি নেই। এরপর দেখবেন অতিরিক্ত ওজন না হালকা এবং ওভারওল কোয়ালিটি কেমন। সবসময় চেষ্টা করবেন কোন ট্রাস্টেড দোকান, পরিচিত ব্র্যান্ড অথবা আপনার প্রেসক্রাইব কৃত ডাক্তার থেকে লেন্স সংগ্রহ করতে।
সুবিধাজনক ফ্রেম
ব্যবহার এবং ওজনের উপর নির্ভর করে আপনি যে কোন ধরনের ফ্রেম নির্বাচন করতে পারবেন। তবে কম্পিউটার গ্লাস ফ্রেম নির্বাচন করার সময় আপনি-
- মুখের অবয়ব
- ওজন
- সাইজ
- কালার
ইত্যাদির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিবেন। এতে উক্ত গ্লাস পড়ে আপনি যেমন আরাম পাবেন তেমনি যে উদ্দেশ্যে চশমা ইউজ করছেন তা পূরণ হবে।
সাম্প্রতিক ফ্যাশন ট্রেন্ড
চশমা মানব ইতিহাসে চোখের যত্নের পাশাপাশি একটি উচ্চমানের ফ্যাশন উপকরণ। বিভিন্ন দেশে রোদ চশমা হিসেবে হরেক রকমের চশমা ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর ডিজাইন যেমন অনেক সুন্দর হয় তেমনি দেখতেও অনেক সুন্দর ও আধুনিক লাগে।
উপরিউক্ত আলোচনায় একটি কম্পিউটার গ্লাস কি এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আপনি যদি সঠিক প্রক্রিয়ায় চশমা নির্বাচন করেন তাহলে আপনার চোখকে অনেক বেশি সুরক্ষা দিতে পারবেন।