প্রযুক্তি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে যেমন আকর্ষণ আছে তেমনি রয়েছে কৌতূহল। যার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন সময় মানুষ নানা রকমের প্রযুক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণার প্রচলন ঘটায়। আমাদের আজকের লেখায় আমরা এরকম প্রযুক্তি সম্পর্কে ১০ ভুল ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
প্রযুক্তি সম্পর্কে ১০ ভুল ধারণা
নিচে প্রযুক্তি সম্পর্কে ১০ ভুল ধারণা বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।
ফোনের অরিজিনাল চার্জার ছাড়া চার্জ দেওয়া যাবে না
আমরা প্রায় সময় মোবাইল চার্জ দেওয়া নিয়ে নানা ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগি। কারণ ফোন চার্জ দেওয়ার সাথে ব্যাটারির সরাসরি সম্পর্ক আছে। চার্জ দেওয়ার পদ্ধতির উপরে ব্যাটারির স্বাস্থ্য ও চার্জ বেশি সময় থাকা নির্ভর করে। এই সব কিছু মিলিয়ে মানুষ বিভ্রান্তিতে ভোগে এবং ভুল ধারণার সৃষ্টি করে।
যার ফলে অনেকেই নিজের চার্জার বাদে অন্যের চার্জার ইউজ করতে চায় না। মনে করে এতে ব্যাটারির ক্ষতি হয় এবং দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তবে এই ধারণা একেবারে ভুল। আপনি আপনার ফোন যে কোন ধরনের চার্জার দিয়ে চার্জ দিতে পারবেন। তবে এখানে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যেমন-
- ফিচার ফোনের চার্জার দিয়ে শুধু ফিচার চার্জ দেওয়া যাবে
- স্মার্টফোনের চার্জার দিয়ে শুধু স্মার্টফোন চার্জ দেওয়া যাবে
এই ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে চার্জারের আউটপুট ভোল্টেজ যেন ব্যাটারির ভোল্টেজের সমান হয়। এর কমবেশি হলে তা ব্যাটারির জন্য তথা ফোনের জন্য বিপজ্জনক।
ডিলিট করা ফাইল ফিরে পাওয়া যায় না
মোবাইল বা কম্পিউটার চালানোর সময় আমরা ভুল বসত প্রয়োজনীয় ফাইল ডিলিট করে ফেলি। অনেকসময় মেমোরি বা হার্ডডিস্ক ফরম্যাট হয়ে গেলেও ফাইল হারানোর চিন্তায় বিভোর থাকি। আমাদের মাঝে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা আছে যে ডিলিট করা ফাইল ফিরে পাওয়া যায় না।
বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল এবং স্বল্প জ্ঞানের পরিচয়। আমরা যখন কোন ফাইল মেমোরি বা হার্ডডিস্কে জমা করি তখন তা সারাজীবনের জন্য সেখানে সেভ হয়ে থাকে। যখন কোন ফাইল ডিলিট করা হয় এগুলো মেমোরি সেক্টরের ভেতরে জমা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ফাইল ডিলিট করার পরেও এর একটি ভার্সন মেমোরি সেক্টরে জমা হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ফাইল রিকভার করার সফটওয়্যার আছে যে গুলো দিয়ে সহজেই ডিলিট হওয়া ফাইল বের করা যায়।
প্রাইভেট বা ইনকগনিটো মোড পুরোপুরি সুরক্ষিত
বিশ্বব্যাপি প্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর মধ্যে এই ভুল ধারণা কাজ করে যে ইনকগনিটো মোড ব্যবহার করলে ইন্টারনেট থেকে হাইড থাকা যায়। অর্থাৎ আপনি ব্রাউজারে প্রাইভেট মোড চালু করে যে সাইট ব্যবহার করবেন তা ট্র্যাক করা যাবে না। যদিও ইনকগনিটো মোডে ইন্টারনেট ব্রাউজ করলে হিস্টোরি সহ কিছু সাইট ডাটা স্টোর হয় না। তবে এর কিন্তু মানেই পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়।
কারণ প্রাইভেট মোডে ইন্টারনেট ইউজ করলে প্রায় সকল ডাটা উন্মুক্ত থাকে। বলা যায় এটি একটি স্কাম যা মানুষের মাঝে ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে। আপনি ইনকগনিটো মোড চালু করে সেখানে ভিপিএন ব্যবহার করলেও ইন্টারনেটে নিজের পরিচয় গোপন করে ব্রাউজিং করতে পারবেন না।
নিজেকে হ্যাকিং অ্যাটাক থেকে সুরক্ষিত ভাবা
আমাদের মাঝে একটি ভুল ধারণা আছে যে হ্যাকাররা শুধু সেলিব্রেটি ও শিল্পপতিদের ডিভাইস এবং অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। আমরা মনে করি যে আমাদের কাছে এমন কোন তথ্য নেই যার জন্য আমাদের ডিভাইস বা অ্যাকাউন্ট হ্যাক হবে। তবে এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর ধারণা।
হ্যাকিং বিশ্বে আইডেন্টিটি থেফট বা ব্যক্তিগত পরিচয় চুরি পরিচিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একজন হ্যাকার অনলাইনে বা অফলাইনে আপনার ক্রেডিট কার্ড, নাম এবং ঠিকানা ব্যবহার করে আপনার অনেক ক্ষতি সাধন করতে পারে। যেমন আপনার পরিচয় দিয়ে সে আপনার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কেনাকাটা, ইলিগ্যাল কাজ, ঝগড়া বাধানো ইত্যাদি করতে পারবে। অর্থাৎ অনলাইনে নিজেকে সেফ মনে করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
ম্যাক ও আইফোনে ভাইরাস অ্যাটাক হয় না
নিউজ সাইট বা অনলাইন ব্লগে আমরা প্রায় সময় উইন্ডোজ এবং অ্যান্ড্রয়েড হ্যাক হওয়ার কথা শুনে থাকি। বহুল ব্যবহৃত এই অপারেটিং সিস্টেম দুইটি সবসময় হ্যাকারদের নজরে থাকে। এই সিকিউরিটি দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অ্যাপল তাদের প্রোডাক্ট যেমন ম্যাক, আইফোন ও অ্যাপল ওয়াচের মার্কেটিং করে। তাদের মতে অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেম তথা ডিভাইস গুলো হ্যাক হয় না। তবে অন্যান্য ডিভাইস যে হিসেবে হ্যাক হওয়ার খবর আসে অ্যাপল ডিভাইস হ্যাক হওয়ার তেমন খবর আসে না।
কারণ অ্যাপল তাদের প্রোডাক্ট তৈরি করার সময় সিকিউরিটির দিকে অনেক বেশি ফোকাস করে। এই কারণে তাদের ডিভাইস হ্যাক করার জন্য সিকিউরিটি দুর্বলতা পাওয়া যায় না। তবে ২০২২ সালের জুলাইতে তাদের সিস্টেমে “IOMobileFrameBuffer” নামে একটি দুর্বলতা পাওয়া যায়। যদিও তারা দ্রুত সিকিউরিটি আপডেট দিয়ে তা সমাধান করে ফেলে। তবে প্রযুক্তি দুনিয়ায় কোন ডিভাইস হ্যাক হওয়া থেকে সুরক্ষিত নয়।
বেশি মেগাপিক্সেল মানে ভালো ছবি
মোবাইল কেনার সময় আমরা সব থেকে বেশি যে বিষয়ে গুরুত্ব দেই তা হচ্ছে ক্যামেরা কত মেগাপিক্সেল এবং র্যাম কত। তবে আপামর মোবাইল ইউজার সবসময় বেশি মেগাপিক্সেল সহ ক্যামেরা কিনতে চায়। কারণ তারা মনে করে মেগাপিক্সেল যত বেশি হবে ছবি এবং ভিডিও তত সুন্দর হবে। তবে এই ধারণা একদম ভুল এবং বিভ্রান্তমূলক।
অন্যদিকে আমরা মোবাইলে বেশি মেগাপিক্সেল থাকলে তাকে ডেডিকেটেড ক্যামেরা থেকে বেশি ভালো মনে করি। তবে ছবি ভালো তোলার জন্য মেগাপিক্সেলের পাশাপাশি সেন্সর, আইএসও সেটিং, এক্সপোজার, সাটার স্পিড, লেন্স কোয়ালিটি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। একটি ফোন ক্যামেরায় এগুলোর ব্যবহার লিমিটেড থাকে। মোটকথা একটি ১০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা দিয়ে যেমন ছবি তুলতে পারবেন ৩০ মেগাপিক্সেল ফোন দিয়েও তেমন ছবি আসবে না। অর্থাৎ এখনি সময় এই ভুল ধারণা থেকে বের হওয়ার না হলে ক্যামেরা ফোন বলে চালিয়ে দেওয়া মার্কেটিং স্কাম থেকে বের হতে পারবেন না।
অ্যালেক্সা সব সময় কথা রেকর্ড করে
আমরা ধারণা করে থাকি অ্যালেক্সা, সিরি যেগুলো ভয়েস কমান্ড বুঝে কাজ করে তারা আমাদের জন্য সিকিউরিটি রিস্ক। অর্থাৎ আমরা মনে করি এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল কথা বার্তা রেকর্ড করে। যদিও এই অবিশ্বাসের যুগে এমন চিন্তা করা স্বাভাবিক তবে এই ধরনের ডিভাইস আমাদের কথা রেকর্ড করে রাখে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন অ্যালেক্সাকে কোন কমান্ড দেওয়ার আগে “Alexa” নামক জেগে ওঠার কমান্ড দেওয়া হয়। অর্থাৎ আপনি এই ওয়ার্ড উচ্চারণ করার আগে পর্যন্ত উক্ত ডিভাইস আপনার কোন কথা রেকর্ড করে না। জেগে ওঠার কমান্ড দেওয়ার পর তা কথা রেকর্ড করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। কাজ শেষ হলে রেকর্ড করা ডাটা ডিলিট করে দেয়। অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য আপনি এই পণ্যগুলোর সাথে আসা সিকিউরিটি ফিচার ব্যবহার করতে পারেন।
ইন্টারনেটে থাকা সকল ডাটা সঠিক
গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে ইন্টারনেটে থাকা মোট ডাটার ৬০ শতাংশ মানুষের যোগ করা। বাদ বাকি ৪০% এআই বা অন্যান্য মাধ্যম থেকে তথ্য অ্যাড করা। ইন্টারনেটে ডাটা অ্যাড হওয়ার মাধ্যম গুলো বিবেচনা করলেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সত্য ঘটনার থেকে মিথ্যা ঘটনাই বেশি। তবে যে সকল ঘটনা অনেক জনপ্রিয় সে সকল বিষয়ে তেমন ভুল তথ্য না থাকলেও যেগুলো কম পপুলার সেগুলোতে ভুল ডাটা দিয়ে ভর্তি। এই কারণে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত কোন তথ্য বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম থেকে আগে যাচাই করে নিবেন। না হলে আপনার মাধ্যমে ভুল ডাটা যেমন গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
চার্জ ১০০% হওয়ার পর চার্জে লাগিয়ে রাখলে ফোন ব্লাস্ট হয়
এটি একটি ভুল ধারণা। বর্তমান সময়ে যে সকল মোবাইল ফোন তৈরি করা হয় সেগুলোতে অনেক সিকিউরিটি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে আপনার ফোন যখন ১০০% চার্জ হয় তখন এর মধ্যে থাকা সেটিং চার্জার থেকে চার্জ গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। এতে ব্যাটারিতে অতিরিক্ত চার্জ প্রবেশ করে না। তাই অতিরিক্ত চার্জ হওয়ার কারণে ফোন ব্লাস্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে ব্যাটারিতে যদি পূর্বে থেকেই কোন সমস্যা থাকে তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
দামি এইচডিএমআই কেবল মানেই ভালো পিকচার কোয়ালিটি
আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি দামি ক্যাবল ব্যবহার করলে অনেক বেশি ক্লিয়ার ও জীবন্ত ছবি দেখতে পারবো। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে বেশি পরিষ্কার আউটপুট দেখতে অনেকেই হাজার হাজার টাকা দামের এইচডিএমআই ক্যাবল কিনে থাকে। তবে দুইটি ভিন্ন দামের ৩ মিটার ক্যাবলের মধ্যে আপনি তেমন কোন পার্থক্য দেখতে পাবেন না।
উপরিউক্ত আলোচনায় প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের যে যে ধরনের ভ্রান্ত ধারণা থাকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি এখন থেকে উপরে বর্ণিত বিষয়ে আপনার মধ্যে কোন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা কাজ করবে না।